দৃষ্টিনন্দন লাল কস্তুরি ফুল

কার্তিকের এক সকালে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। একসময় পাকা রাস্তা ছেড়ে ইটের সুরকি বিছানো গ্রামের রাস্তা ধরে যাচ্ছিল আমাদের গাড়ি। রাস্তার দুই ধারে ফসলের মাঠ, বিভিন্ন ঝোপঝাড়, শিম–লাউয়ের মাচায় মিঠে রোদের হাসি দেখছিলাম।

গন্তব্য ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কুণ্ডবালিয়া গ্রামের ডাক্তার বাড়ি। গত বছরের ২৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার নবমীর দিনে গিয়েছিলাম সেখানে। বাড়ির উঠানে পৌঁছালে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় পুকুরের পাড়ে। সেখানেই দেখা পাই লাল কস্তুরি উদ্ভিদের।

এর আগে ১৩ অক্টোবর গিয়েছিলাম আমার সাবেক কর্মস্থল ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজে। অধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনের বাগানে শহীদ মিনারের সামনে লাল কস্তুরিগাছের সন্ধান পাই। দেখলাম তাতে লাল টকটকে ফুল ফুটে আছে। ফুল দেখে বোঝা যায় এটি ঢ্যাঁড়সের নিকটাত্মীয়। ছবি তুলে ফেলি সঙ্গে সঙ্গে।

লাল কস্তুরি একটি সুন্দর, নরম, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এর কাণ্ড নরম লোমযুক্ত এবং মূল লম্বা, সরু। লাল কস্তুরির বৈজ্ঞানিক নাম Abelmoschus moschatus, এটি Malvaceae পরিবারের সদস্য। Abelmoschus শব্দটি আরবি আবু-এল-মস্ক থেকে এসেছে। যার অর্থ কস্তুরির পিতা বা কস্তুরির অধিকারী। বিশেষ জাতের হরিণের নাভির গ্রন্থি থেকে মূল্যবান সুগন্ধি দ্রব্য কস্তুরি সংগ্রহ করা হয়। লাল কস্তুরির বীজের গন্ধ কস্তুরির মতো বলেই এরূপ নাম হয়েছে। হলুদ ফুলের লতা কস্তুরির বীজের গন্ধও কস্তুরির মতো।

এই উদ্ভিদের আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া, কুক আইল্যান্ড, ফিজি, ভারত ও সামোয়া। এটি ভোজ্য ওকরা বা ঢ্যাঁড়সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই ফুলকে অনেকে মেস্তা জবা বলে ভুল করেন। কিন্তু মেস্তা জবা আর লাল কস্তুরি একই গোত্রের ভিন্ন উদ্ভিদ।

 এর পাতা হৃৎপিণ্ড আকৃতির, লোমশ, করতলাকার, খণ্ডযুক্ত, পাতার কিনারা করাতের মতো খাঁজযুক্ত। পাতার বিন্যাস একান্তর। ফুল উভলিঙ্গিক, মঞ্জরিপত্র ৮-১২টি, জবার মতো। পাপড়ি সাধারণত লাল। উদ্ভিদ অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মধ্যে জন্মায়। বৃষ্টির মৌসুমের ওপর এই উদ্ভিদের জন্মানো নির্ভর করে। ফল ক্যাপসুল, ৬-৮ সেন্টিমিটার লম্বা, ডিম্বাকার-নলাকার। বীজ কিডনি আকৃতির এবং কালো, লোমযুক্ত, শক্ত কিন্তু কাগজের মতো পাতলা এবং কস্তুরি-গন্ধযুক্ত। বংশবৃদ্ধি হয় বীজের দ্বারা।

এই উদ্ভিদকে ভারতে প্রাক্‌-খরিফ ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। এপ্রিলে বপন করা ফসলে সেপ্টেম্বরে ফুল ফোটা শুরু করে, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ফল পাকে এবং সম্পূর্ণ পরিপক্ব হলে ক্যাপসুলগুলো রোদে শুকানো হয় এবং ক্যাপসুলগুলো ফেটে গেলে বীজগুলো শুকিয়ে যায়। সুগন্ধি তৈরির জন্য তেল চূর্ণ বীজের বাষ্প পাতন দ্বারা নিষ্কাশন করা হয়।

ফিজিতে এটিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৫০ মিটার উচ্চতায় পাওয়া যায় আগাছা হিসেবে। বংশ বিস্তার বীজ বা কাণ্ডের কাটিং থেকে হতে পারে। বীজ সহজেই অঙ্কুরিত হয়, তবে গাছটিকে মাটিতে স্থাপন করতে কিছু অসুবিধা হয়। ভালো পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা আছে এবং পাথুরে জায়গায় বীজ বপন করলে ভালো হয়।

শিকড়, পাতা, বীজ মূল্যবান ঐতিহ্যগত ওষুধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তেতো, মিষ্টি, তীক্ষ্ণ, সুগন্ধি বীজ টনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চক্ষুসংক্রান্ত, পাকস্থলীসংক্রান্ত, কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসায়, মূত্রবর্ধক, উদ্দীপক হিসেবে এবং অন্ত্রের সমস্যায় কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়।

এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের রোগের চিকিৎসায়, হৃদ্‌রোগে টনিক হিসেবে, হজমকারক হিসেবে, পেশির খিঁচুনির চিকিৎসায়, ত্বকের রোগের নিরাময়ে, বমি পরীক্ষায় এর ব্যবহার রয়েছে। ইউনানি পদ্ধতি অনুসারে এর বীজ তৃষ্ণা নিবারণ করে এবং চুলকানি নিরাময় করে। মূল ও পাতা গনোরিয়া নিরাময় করে। বীজ থেকে প্রাপ্ত তেলে কস্তুরির মতো গন্ধ থাকে এবং ইউরোপে মূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

  • চয়ন বিকাশ ভদ্র, অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক