ঢাকার চায়ের দোকানে মৌমাছি কেন, কিসের লক্ষণ
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের একটি চায়ের দোকান। ফুটপাতের আর দশটা দোকানের মতোই। তবে একটি ক্ষেত্রে দোকানটি ভিন্ন, যা পথচলতি অনেকেরই নজর কাড়ে। সেটি হলো, সেখানে অনেক মৌমাছির আনাগোনা।
গত ২৭ অক্টোবর ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এ প্রতিবেদকেরও একই কারণে দোকানটিতে চোখ পড়ে। চিনি রাখার পাত্রে বসে আছে অনেক মৌমাছি। দুধের কৌটা-চায়ের কাপসহ অন্যান্য জায়গায়ও বসছে বেশ কিছু। কিছু মৌমাছি ওড়াউড়ি করছে।
দোকানি জাকারিয়া নিশান চা বানানোর সময় কখনো মৌমাছিগুলোকে একটু সরিয়ে, কখনো–বা একটু ফাঁক পেলে সেখান থেকেই চিনি নিচ্ছিলেন। চিনি নেওয়ার সময় প্রায়ই চামচের সঙ্গে মৌমাছিও এসে পড়ছিল, উড়েও আসছিল দু-একটা চায়ের কাপে। এতে বিরক্ত না হয়ে বরং যত্নসহকারে মৌমাছি সরিয়ে দিয়ে পুরো চা বানানোর প্রক্রিয়া শেষ করছিলেন দোকানদার।
দোকানি জাকারিয়া নিশানের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের হাজিরপাড়া ইউনিয়নে। ঢাকার কাপ্তানবাজারে থাকেন তিনি। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাতে বছর তিনেক ধরে দোকান করছেন। তিনি জানান, শুরু থেকেই তাঁর দোকানে মৌমাছি আসে। প্রতিদিন সকালে দোকান খুললে মৌমাছির দল আসে, সন্ধ্যায় চলে যায়।
জাকারিয়ার কথা বলার সময়ই একজন চা খেতে এসে চিনি ঢেকে রাখার জন্য বললেন। তবে এতে ঘোর আপত্তি জানিয়ে জাকারিয়া বললেন, ‘ঢেকে রাখব কেন? আমার তো অসুবিধা নাই। ওরা (মৌমাছি) খাইয়্যা বাঁচুক।’ এর সঙ্গে আরও যোগ করলেন, এই মৌমাছি তো কাউকে কামড় দেয় না, তবে আঘাত করলে দেয়।
জাকারিয়ার ভালোবাসা ও যত্নে তাঁর দোকানে মৌমাছির দল নিরাপদ বোধ করে, এ কথা হয়তো বলা যায়। কেননা, তাঁর দোকানের পাশে আরও দুটি দোকান রয়েছে। ওই দুটি দোকানের চিনির পাত্রে মৌমাছির অবশ্য তেমন ভিড় দেখা গেল না।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ছাড়াও রমনার কালীমন্দিরের ফটকের সামনের চায়ের দোকানের চিনির পাত্রেও মৌমাছির দেখা পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকার চায়ের দোকানসহ মিষ্টির দোকানেও মৌমাছির দেখা পাওয়া যায়।
চায়ের দোকানে মৌমাছি কেন
চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ ভাগের কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় পর্যাপ্ত গাছপালা ও ফুল না থাকায় খাদ্যসংকটে থাকে মৌমাছি। প্রকৃতিতে খাদ্যসংকট থাকায় মৌমাছি চায়ের দোকানে থাকা চিনির মতো কৃত্রিম খাদ্যের দিকে ছুটছে।
ক্লান্তিকালীন মৌমাছির খাবার গ্রহণের আচরণের ওপর গবেষণা করেছেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন। প্রকৃতিতে মৌমাছির খাদ্যের সংকট আছে উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরে তো বেশি গাছপালা নেই। গাছে যখন ফুল থাকে, তখন এরা খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। যখন ফুল থাকে না, তখন এরা চিনি, গুঁড়, মিষ্টির মতো কৃত্রিম উৎসের দিকে যায়।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও রমনায় যে মৌমাছি দেখা গেছে, সেগুলো আকারে তুলনামূলক ছোট। যেসব স্থান থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়, সেসব স্থানের মৌমাছি আকারে বেশ বড় হয়। এসব মৌমাছি চাক বেঁধে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বেশ কিছু প্রজাতির মৌমাছি আছে। কিছু প্রজাতির মৌমাছি ছোট ছোট দল বেঁধে থাকে। মধু দেয় না, নিজেরা যা জোগাড় করে, তা নিজেরাই খায়। এদের মধ্যে কোনো কোনো প্রজাতির মৌমাছির চিনির মতো কৃত্রিম জিনিসে আসার প্রবণতা আছে। তবে প্রকৃতিতে পর্যাপ্ত খাবার থাকলে সাধারণত কৃত্রিম খাদ্যের দিকে মৌমাছি ঝোঁকে না বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
দোকানভেদে কেন কমবেশি
কোনো চায়ের দোকানে বেশি মৌমাছি, আবার কোনো দোকানে কম কেন, এর একটা ব্যাখ্যাও দিলেন কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সাখাওয়াৎ হোসেন। তিনি মনে করেন, খাবারের উৎস (চায়ের দোকান বা মিষ্টির দোকান) থেকে তাদের বাসার দূরত্ব, সূর্যের আলো—এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মৌমাছিরা দোকান নির্ধারণ করে।
মৌমাছির নৃত্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করে উল্লেখ অধ্যাপক সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, চাক বা বাসা থেকে খাদ্যের সন্ধানে প্রথমে যে মৌমাছি বের হয়, এরা বাসা থেকে দূরত্ব ও সূর্যের আলোর ওপর ভিত্তি করে খাদ্যের উৎস (দোকান বা অন্য কিছু) নির্বাচন করে। বাসায় ফিরে গিয়ে ওই মৌমাছি একটি ভঙ্গিতে নৃত্য করে। নৃত্যের সেই ভঙ্গি দেখে বাকি মৌমাছিরা বুঝতে পারে, খাদ্যের উৎস কোথায়। পরে বাকি ওই মাছি সেই উৎসে বা দোকানেই যায়।
আবার দোকানিরা মনে করেন, কোনো দোকানি বিরক্ত হলে বা নির্যাতন করলে সেসব দোকানে মৌমাছি কম যায়।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে জাকারিয়া নিশানের চায়ের দোকানে অবস্থানের সময় দেখা যায়, দোকানে থাকা দুধের কৌটায় পড়ে একটি মৌমাছি মারা গেল। এই দোকানসহ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের তিনটি ও রমনার আরও একটি দোকানের দোকানি জানান, প্রতিদিনই তাঁদের দোকানে কিছু মৌমাছি নানাভাবে মারা যায়। জাকারিয়া জানান, সতর্ক থাকার পরও পানিতে, দুধের কৌটায়, চায়ের কাপে পড়ে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি মৌমাছি মরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দোকানি ও ক্রেতাদের অসতর্কতা কিংবা বিরক্তির কারণেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌমাছি মারা পড়ে। তা ছাড়া খাদ্যসংকটের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌমাছি অনেক ক্ষুধার্ত থাকে। তখন এরা মিষ্টির রস বা চিনির দোকানে গিয়ে অনেক বেশি খেয়ে ফেলে। এভাবেও কিছু মৌমাছি মারা যায়। ফুলের মধু খেয়ে এভাবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা নেই। প্রকৃতিতে মৌমাছির পর্যাপ্ত খাদ্য থাকলে অনেক মৌমাছি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা
মৌমাছি চিনি, মিষ্টি বা কাপের ওপর বসার বিষয়টি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি কি না—এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন মত পাওয়া গেছে।
এতে কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই বলে মনে করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সাখাওয়াৎ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মৌমাছির নিজস্ব জীবাণু আছে, তবে মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে—এমন জীবাণু এরা বহন করে না। তা ছাড়া মৌমাছি সাধারণত নোংরা জায়গায় বসে না।
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বিষয়টিকে কিছু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বায়ুতে দূষিত ধূলিকণা থাকে। মৌমাছির পাখায়, পায়ে বা হুলে বাতাস থেকে ময়লা লাগতেই পারে। সেটা চিনি বা কাপে গেলে ক্ষতি হতেও পারে।’ তবে মাছি বা মশা যেমন নিজেরা রোগ ছড়ায়, মৌমাছি নিজে এমন রোগ ছড়ায় বলে কোনো তথ্য বা গবেষণা পাওয়া যায় না বলে জানান এই অধ্যাপক।