বাকুর জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে এখনো হতাশার সুর
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ২০০৯ সালের পঞ্চদশ জলবায়ু সম্মেলনে ঠিক হয়েছিল, পরিবেশের উন্নতিতে উন্নত দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে। সেই লক্ষ্যমাত্রাকে ঢের পেছনে ফেলে এখন প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে বাৎসরিক ১০ গুণ বেশি অর্থ। বছরে অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলার খরচের সেই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নাকি আকাশ কুসুম—সেই বিতর্কের অবসান আজও হলো না। বাকুতে ‘কপ২৯’–এর দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেও ধোঁয়াশা কাটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনসিটিএডি) মহাসচিব রেবেকা গ্র্যান্সপ্যান বলেছেন, আগামী বছর বরাদ্দ হওয়া উচিত ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি বলেছেন, জরুরি প্রশ্ন এটা নয় যে এই টাকা উন্নত বিশ্ব দেবে কি না। প্রশ্ন কত দ্রুত তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সেই জরুরি পদক্ষেপ যে নেওয়া হচ্ছে না, সেই আক্ষেপ ঝরে পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চেম্বারের মহাসচিব জন ডব্লিউ এইচ ডেনটনের কথায়। তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বা গ্লোবাল মেল্টডাউনের মোকাবিলায় সবাই যেমন উদ্যোগী হয়েছিল, জলবায়ু সংকট মেটাতে তেমনই তৎপরতা সবার দেখানো উচিত। অথচ সর্বত্র যেন একটা ঢিলেঢালা ভাব। তাঁর মতে, অর্থ পাওয়া গেলেও জলবায়ু সংকটের মোকাবিলায় কার্যকর প্রকল্পগুলো প্রস্তুত কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। সে দায়িত্ব উন্নয়নশীল দেশগুলোর।
এই একই কথা অন্যভাবে বলেছেন ইউরোপীয় উন্নয়ন ও পুনর্গঠন ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ওডিলে রেনাউত। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, লক্ষ্য স্থির করা একমাত্র সমাধান নয়। লক্ষ্যমাত্রা একটা মাধ্যম। অর্থায়ন হলেও উন্নয়নশীল দুনিয়া কীভাবে কয়লা ও গ্যাস থেকে বের হয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের রূপরেখা গ্রহণ করবে, সেই রোডম্যাপ তৈরি থাকা সমান জরুরি।
ঘটনা হলো, পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরা মনে করছেন, বছর বছর এই যে ঘটা করে এত আয়োজন, তাতে কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না। যেমন পানামার পরিবেশমন্ত্রী জুয়ান কার্লোস নাভাররো বলেছেন, তাপমাত্রা কমানো ও নির্গমনের ক্ষেত্রে তাঁদের দেশের দায়িত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানামা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। যথেষ্ট খেদের সঙ্গে তিনি বলেছেন, এই সব সম্মেলনে দেখছি বিস্তর কথা হচ্ছে। প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই প্রায় হচ্ছে না। আফ্রিকার জলবায়ু বিষয়ে চিন্তন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার শিফটের কর্তা মোহামেদ আদৌ রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ১৫ বছর ধরে জলবায়ু সম্মেলনে আসছেন। এত হতাশজনক ও খারাপ প্রথম সপ্তাহ আগে কখনো দেখেননি।
পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরা এই সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, পরপর দুটি কপ সম্মেলনই শক্তির (এনার্জি) দিক থেকে শক্তিশালী দেশে অনুষ্ঠিত, যা ‘দুঃখজনক’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপান, কানাডা ও ইতালির প্রতিনিধিদলে জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থাগুলোর কর্তারা রয়েছেন। পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর জোট ‘কিপ দ্য বিগ পলিউটারস আউট’ জানিয়েছে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিনিধিদলের কর্তাদের মধ্যে ১ হাজার ৭৭০ জন এসেছেন, যাঁরা জীবাশ্ম জ্বালানির পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা বলছেন, এটা হলো ফুসফুসের ক্যানসার নিয়ে আয়োজিত সম্মেলনে তামাক লবিস্টদের ছড়ি ঘোরানোর মতো ব্যাপার!
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর স্পষ্ট করে এ কথাটাই বলেছেন। তাঁর কথায়, দুঃখজনক এটাই যে জলবায়ু আন্দোলনের রাশ ক্রমেই ফসিল ফুয়েল শিল্প ও পেট্রোস্টেটদের (জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল দেশ) হাতে চলে যাচ্ছে। পরিবেশ প্রক্রিয়ার ওপর তারা অস্বাস্থ্যকর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে।
এই যেখানে বাস্তব সেখানে জলবায়ু সম্মেলনের সাফল্য নিয়ে কতটা আশান্বিত হওয়া যায়? শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ওঝা কী করে ছাড়াবে?