গবেষণা
রক্ষিত বনের গাছও রেহাই পায়নি
জীববৈচিত্র্য দিবস আজ
দেশে রক্ষিত বন ৫৩টি। গবেষণা হয়েছে ২৮টি নিয়ে।
দুই দশকে এসব বনে ১৪ হাজার ৭৬৭ হেক্টর জমির গাছপালা উজাড়।
রাঙামাটির পাবলাখালী বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যে বিধুর চাকমা (৪৭) ছোটবেলায় যে গাছপালা দেখেছিলেন, এখন তার অর্ধেকও নেই। দিন দিন এ বনে বসতি বেড়েছে, কাটা পড়েছে গাছ। যদিও বনটি ‘রক্ষিত শ্রেণিভুক্ত’।
বিধুর চাকমার বাড়ি বনসংলগ্ন দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামে। তিনি গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলছিলেন, বন রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে গাছ কাটা বন্ধ হয়নি।
পাবলাখালী বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যের মতো দেশের ৫৩টি রক্ষিত বনের ২৮টির উপগ্রহচিত্র নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুই দশকে প্রতিটি বনে গাছ কমেছে।
এ অবস্থায় আজ বুধবার (২২ মে) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। চলতি বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘জীববৈচিত্র্যের পরিকল্পনার অংশ হোন।’
দুই দশকে ২৮টি বনে গাছ কমেছে। বন রক্ষায় সরকারি প্রকল্পে আশানুরূপ সাফল্য নেই।
দেশের ২৮টি রক্ষিত বন নিয়ে গবেষণাটি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রিমোট সেন্সিং ও জিআইএস বিভাগে’র সহকারী অধ্যাপক মো. ফরহাদুর রহমান। গবেষণার আওতায় এসেছে ১৪টি জাতীয় উদ্যান ও ১৪টি বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। জাতীয় উদ্যানগুলোর মধ্যে আছে আলতাদীঘি, বারোইয়াঢালা, ভাওয়াল, বীরগঞ্জ, হিমছড়ি, কাদিগড়, কাপ্তাই, খাদিমনগর, লাউয়াছড়া, মধুপুর, মেধাকচ্ছপিয়া, নবাবগঞ্জ, সাতছড়ি ও সিংড়া। আর বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যের মধ্যে আছে চর কুকরিমুকরি, চুনতি, দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি, ফাইস্যাখালী, হাজারীখিল, পাবলাখালী, রেমাকালেংগা, সাঙ্গু, সোনারচর, সুন্দরবন-পূর্ব, সুন্দরবন-দক্ষিণ, সুন্দরবন-পশ্চিম, টেংরাগিরি ও টেকনাফ।
গবেষণায় শাল, পাহাড়ি ও ম্যানগ্রোভ—তিন ধরনের রক্ষিত বনের ভূমির অবস্থা পর্যবেক্ষণে গুগলের তোলা বিভিন্ন সময়ের ছবি ব্যবহার করা হয়। ছবিগুলো পাওয়া গেছে ল্যান্ডসেট উপগ্রহ থেকে। বনের পরিবর্তন দেখতে কন্টিনিউয়াস চেঞ্জ ডিটেকশন অ্যান্ড ক্ল্যাসিফিকেশন (সিসিডিসি)–পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
গবেষক মো. ফরহাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বনের আচ্ছাদনের অবস্থা কী, তা দেখতেই এ গবেষণা।
কোন বনের কী অবস্থা
গবেষণার আওতায় আসা সব কটি বনেই গাছ কমেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বনে গাছ উজাড় হয়েছে বেশি। তার মধ্যে আবার রাঙামাটির পাবলাখালীর ক্ষতি বেশি হয়েছে। ২০ বছরে বনটিতে ৮ হাজার ৩১৮ হেক্টর এলাকা সবুজহীন হয়ে গেছে।
এর পরের অবস্থানে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাঙ্গু বন। সেখানে ১ হাজার ১০০ হেক্টর বনের গাছ ধ্বংস হয়েছে। চুনতি বনের সাড়ে ৯ হেক্টর ও কাপ্তাই বনের প্রায় ৯০০ হেক্টরের গাছ উজাড় হয়েছে।
শালবন অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাছ ধ্বংস হয়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে, ১৭৭ হেক্টর। সুন্দরবনের তিনটি রক্ষিত এলাকার মধ্যে সুন্দরবন-পূর্ব রক্ষিত এলাকার সবচেয়ে বেশি ১২৯ হেক্টর এলাকার গাছ ধ্বংস হয়েছে।
রক্ষিত বনে গাছ কমার বিষয়টি পুরোপুরি মেনে নিতে নারাজ উপপ্রধান বন সংরক্ষক গোবিন্দ রায়। তিনি এখন বনের সহব্যবস্থাপনায় নেওয়া বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প ‘সুফল’–এর প্রকল্প পরিচালক। তাঁর কথা, ‘দেশে সবুজের আচ্ছাদিত এলাকা বেড়েছে। তবে বনে যে সবুজ কমেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।’
অবশ্য গবেষক ফরহাদুর রহমানের গবেষণায় এসেছে—২৮টি বনে ১৪ হাজার ৭৬৭ হেক্টর জমির গাছপালা উজাড় হয়েছে। উল্লেখ্য, রক্ষিত বনে গাছ কাটা ও স্থাপনা করা বন আইনে নিষিদ্ধ।
বনের হাল ফেরে না
যে ২৮টি রক্ষিত বনে গাছ ধ্বংসের চিত্র পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ২৫টিতেই বন টেকসই করতে নানা সময় সহব্যবস্থাপনা কৌশল চালু করা হয়েছিল। সহব্যবস্থাপনা হলো বনের সুরক্ষায় স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করা। এই ধারণা থেকেই মানুষকে বন ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত করা হয় যে এতে তাঁরা বন ধ্বংস করা বাদ দেবেন।
দেশের রক্ষিত বনগুলোর মধ্যে পাঁচটিতে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির সহায়তায় ‘নিসর্গ’ প্রকল্প চালু হয়। ২২টি রক্ষিত এলাকায় ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৮টি সহব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়।
নিসর্গ প্রকল্প যে পাঁচটি বনে শুরু হয়, তার মধ্যে চুনতি অভয়ারণ্য একটি। চুনতি এলাকার বাসিন্দা সানজিদা রহমান ১৯৭৬ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। তাঁর দেখা সেই বন তখন এতটাই জঙ্গলাকীর্ণ ছিল যে দিনের বেলাও অনেক সময় ভেতরে ঢুকতে আলো জ্বালাতে হতো। সানজিদা বলেন, এখন গাছপালা কমতে কমতে অর্ধেকে নেমেছে। গাছ কমেছে বনে অবৈধ বসতি স্থাপন, পাহাড় কাটা, বালু উত্তোলন ও গাছ চুরির কারণে।
সহব্যবস্থাপনা যে আশানুরূপ সাফল্য আনতে পারেনি, তা স্বীকার করে বন বিভাগও। তাদের ‘সহব্যবস্থাপনায় অর্জিত সাফল্য’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, আর্থিক প্রতিবন্ধকতা, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনীতিবিদদের প্রভাব, প্রকল্পনির্ভরতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রম এখনো আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিমউদ্দীন খান ২০০৪ সাল থেকে নিসর্গ প্রকল্পসহ বন বিভাগের রক্ষিত বনে নানা প্রকল্প নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধ্যাপক তানজিমউদ্দীন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিসর্গ, আইপ্যাক, ক্রেল, সুফলসহ বড় বড় প্রকল্পে দেখেছি। সেখানে জীববৈচিত্র্য রক্ষার চেয়ে বনকে আয়ের উৎস হিসেবেই দেখা হয়েছে। এখানে বাণিজ্যিক লাভালাভের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।’
তানজিমউদ্দীন খান আরও বলেন, এসব করতে গিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে বন বিভাগের অসাধু কর্মীদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। তাতে বন ধ্বংস বন্ধ হয়নি; বরং ধ্বংসের হার বেড়েছে।