শরৎ–হেমন্তে ফোটে মিনজিরি
বিজ্ঞানলেখক এবং বরেণ্য নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে মস্কো থেকে দেশে ফিরে আসেন। যুক্ত হন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া প্রণয়নের কাজে। এ সময় প্রায় প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। এশিয়াটিক সোসাইটির কাজ শেষে তিনি হেঁটে আসতেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার মাজার লাগোয়া ফটকে। অফিস থেকে বেরিয়ে আমি তাঁর জন্য সেখানে অপেক্ষা করতাম। তারপর গল্প করতে করতে আমরা পৌঁছে যেতাম রমনা পার্কে। এ সময় তিনি অনেক গাছ চিনিয়েছেন আমাকে, যার একটি মিনজিরি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার মাজার লাগোয়া গেট থেকে সোজা হেঁটে খানিকটা এলেই ডান পাশে কিছুটা হেলানো ভঙ্গিতে পাওয়া যাবে গাছটি। গড়নের দিক থেকে গাছটি কিছুটা বিক্ষিপ্ত হলেও প্রস্ফুটন–প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে কনকচূড়া, ভালো করে লক্ষ করলে পার্থক্যটা বোঝা যায়। পাতা ও কাণ্ডের রং আলাদা, গাছ তুলনামূলকভাবে উঁচু এবং ফুলগুলো থাকে গাছের উপরিভাগে। বিশেষ করে শরৎ-হেমন্তে আমাদের দেশে যখন উঁচু গাছে বাহারি ফুলের সংকট থাকে, তখন মিনজিরি সে ঘাটতি পূরণ করে। এ কারণে ছয় ঋতুর বিন্যাসে গাছটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ সময় তিনি অনেক গাছ চিনিয়েছেন আমাকে, যার একটি মিনজিরি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার মাজার লাগোয়া গেট থেকে সোজা হেঁটে খানিকটা এলেই ডান পাশে কিছুটা হেলানো ভঙ্গিতে পাওয়া যাবে গাছটি।
একসময় দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক বা মহাসড়কে এ গাছ প্রচুর পরিমাণে লাগানো হয়েছিল। বন বিভাগের কর্মীরা গাছটিকে হলুদ কৃষ্ণচূড়া নামে বেশি চেনেন। তবে গড়নে বিক্ষিপ্ততা এবং নরম কাণ্ড ও ডালপালার কারণে সংকীর্ণ পথপাশে গাছটি ঝুঁকিপূর্ণ। সড়ক-মহাসড়কের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। এই গাছ রোপণের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষায়নের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। বিশেষায়িত জ্ঞানের বিষয় তো সুদূরপরাহত। যে কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষায়নে অতি বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়।
মিনজিরি গণের আরেকটি উদ্ভিদ ক্যাশিয়া। সারা বিশ্বে ক্যাশিয়ার অনেক রকমফের ছড়িয়ে আছে। সে তুলনায় আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। যে কটি আছে, তার মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতিই সংখ্যায় কম। উদাহরণ হিসেবে ক্যাশিয়া গ্লাওকা ও ক্যাশিয়া ব্যাকেরিয়ানার কথা বলা যায়। মিনজিরিও তুলনামূলকভাবে দুষ্প্রাপ্য।
মিনজিরি (Senna siamea) মিয়ানমার, মালয়েশিয়ার উদ্ভিদ প্রজাতি। মাঝারি আকৃতির চিরসবুজ বৃক্ষ, সাধারণত ১২ থেকে ১৪ মিটার উঁচু হতে পারে। যৌগপত্র ১-পক্ষল, জোড়পক্ষ, ২০ থেকে ৩০ সেমি লম্বা, পাতা ১২ থেকে ২০টি, মসৃণ, ৪ থেকে ৬ সেমি লম্বা। গ্রীষ্ম থেকে শীত পর্যন্ত ফুল থাকে, তবে শরতে বেশি। ডালের আগায় হলুদ ফুলের বড় বড় খাড়া থোকা। ফুল ২ থেকে ৫ সেমি চওড়া। শুঁটি চ্যাপটা, ১৫ থেকে ২৫ সেমি লম্বা এবং দেড় থেকে ২ সেমি চওড়া, রং বাদামি। বীজ অনেক। সাধারণত বীজেই চাষ। গাছটি ভঙ্গুর, বৃষ্টি ও বাতাসে ডাল ভেঙে পড়ে। জন্মস্থান মিয়ানমার, মালয়েশিয়া।
এই উদ্ভিদ বিবিধ ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ। এতে বারাকোল নামে একধরনের যৌগ রয়েছে। মিয়ানমার ও থাই রন্ধনপ্রণালিতে পাতা, কোমল শুঁটি ও বীজ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে খাওয়ার আগে সেদ্ধ করে পানি ফেলে দিতে হয়। মিয়ানমারে কচি পাতা সালাদ বা স্যুপে বেশি ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পশুখাদ্য হিসেবে পাতা এবং কাঠ নানান কাজে লাগে।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক