বিপন্ন উদ্ভিদের খোঁজে শালবনে

ধাবমান ফসলের খেতে হ্রাসমান পাহাড় কাঞ্চনপুরের শালবন
ছবি: লেখক

সকালবেলাটা সোনালি রোদে ভরে গেল। সেই সঙ্গে শালবনের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলা হলুদ ফুলে ভরা শর্ষেখেত। ঠিক যেন এঁকেবেঁকে বয়ে চলা হলুদ এক নদী। শর্ষেখেতের দুই ধারে গভীর শালবন, শালবনের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা সরু মেঠো পথ, হয়তো কোনো লোকালয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে।

সেসব লোকালয়ের মানুষেরাই বুনেছে এই শর্ষের বীজ। শর্ষে কাটার পর সেসব জমিতে লাগানো হয়েছে এখন বোরো ধানের চারা। একসময় হয়তো এসব খেতেও ছিল শালগাছ, ধীরে ধীরে শালবনের এলাকা কমে আসছে, বাড়ছে চাষের খেত।

শালবনের মধ্য দিয়ে নিত্যচলাচল, গবাদিপশুর অবাধ বিচরণ, কবিরাজদের গাছপালা সংগ্রহ, নারীদের গাদিলাপাতা তোলা, শীত শেষে চৈত্রদিনে ঝরা শালপাতা কুড়ানিদের পাতা কুড়ানো, ঘরবাড়ি বানানোর জন্য গাছ কাটা, ধান-কলা চাষ করা, অপরিকল্পিতভাবে রিসোর্ট ও কলকারখানা নির্মাণ—সব মিলিয়ে গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের শালবনের অধিকাংশ এলাকার এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

বিপন্ন বনকুলগাছ

বন বিভাগ ফাঁকা হয়ে যাওয়া শালগাছগুলোর জায়গায় নতুন করে লাগাচ্ছে ইউক্যালিপটাস, সেগুন আর আকাশমণি। হয়তো বনভূমির সরকারি মালিকানাটুকু দখলে রাখার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। না হলে সেটাও হয়তো শর্ষেখেত হয়ে যাবে কদিন পরেই। এর পরিণতিতে শালবন থেকে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি।

টাঙ্গাইলের সখীপুরে পাহাড় কাঞ্চনপুরের পাশে শালবনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথাই ভাবছিলাম। বনের নীরবতা ও পাখপাখালির কিচিরমিচির, ঝিঁঝি পোকার ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ শব্দ—এর কিছুই যেন কানে আসছে না; বরং মাথার ওপরে থাকা সূর্যের ছোঁয়া যেন কোথাও কোথাও শালবনের মাটি পেয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে। কিছুদিন আগেও যেখানে স্যাঁতসেঁতে ঘন বনের ভেতরে দোর্দণ্ড প্রতাপে ঝাঁপিয়ে বাড়তে দেখেছিলাম লতা ঢেঁকিয়া ফার্নের গাছ, আজ সেখানে সেগুলোর মরণাপন্ন অবস্থা দেখে মনটা মুচড়ে উঠল।

এখানে মরলেও অন্য কোথাও হয়তো লতা ঢেঁকিয়ারা বেঁচে আছে। শালবনে এ গাছ বিরল নয়। অল্প হলেও দেখা মিলল বনকুল ও বনচালতা বা আজুলিগাছের। ছ্যাচড়া কড়ইগাছ পেলাম একটা, এটা নাকি এখন খুব কমই দেখা যায়। যেসব গাছ শালবন থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বা হারিয়ে যাচ্ছে, সেসব গাছের কী হবে?

ইউনিভার্সিটি অব ফ্রেইবার্গ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন গবেষক মধুপুর জাতীয় উদ্যানের শালবনে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গবেষণা করে শালবনে ৯৫টি পরিবারের ৩৮৫ প্রজাতির উদ্ভিদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেন। গবেষক মো. রায়হানুর রহমান ও তাঁর সাথি গবেষকেরা ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্রে ১৪০ প্রজাতির বৃক্ষ, ৪৮ প্রজাতির গুল্ম, ১৩৫ প্রজাতির বিরূৎ, ৪৬ প্রজাতির লতা, ৯ প্রজাতির ফার্ন, ৫ প্রজাতির পরাশ্রয়ী ও ২ প্রজাতির পরজীবী উদ্ভিদ প্রজাতি শালবনে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

এগুলোর মধ্যে ২১২ প্রজাতির গাছের ঔষধি গুণ রয়েছে। শালবনের প্রায় ৩ শতাংশ প্রজাতির গাছ বিপন্ন ও ২ শতাংশ উদ্ভিদ রয়েছে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। ভুতুম, পিরালু কাঁটা, বনখেজুর বা খুদিখেজুর, বেত, গাদিলা, জংলিকুল বা শিয়ালকুল, শালপান, বানরকলা ইত্যাদি বর্তমানে শালবনের বিপন্ন গাছ।

১৯৮৫ সালেও বাংলাদেশের বনাঞ্চলের প্রায় ৩৬ শতাংশ ছিল শালবন, অতীতে যা কুমিল্লা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে তা কমতে কমতে ১০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুরের কিছু এলাকা ধরে এখন বিক্ষিপ্তভাবে সংকটাপন্ন অবস্থায় টিকে আছে শালবন।

এটুকু বন উজাড় হলে দেশের অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি অচিরেই বিলুপ্ত হবে, সেই সঙ্গে বন্য প্রাণীও। বন ধ্বংসের পরিণতি ভোগ করতে হবে আমাদেরই। শুধু ফসল খেয়ে বাঁচা যায় না, বাঁচার জন্য সবার আগে দরকার অক্সিজেন, যা পাই গাছ থেকে, বনভূমি থেকে। আমাদের জীবন ও অস্তিত্বের জন্যই বনভূমি টিকিয়ে রাখা দরকার।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদপ্রকৃতিবিষয়ক লেখক