তিস্তায় বিরল ভোঁদড়ের দেখা

রংপুরের তিস্তা নদীতে দেখা সেই ভোঁদড়। গত ১৬ ডিসেম্বরছবি: লেখক

মাঝবয়সী মানুষ কিংবা প্রবীণ অনেকেই ভোঁদড় দেখেছেন। বিশেষত যাঁরা গ্রামে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন, তাঁদের কাছে ভোঁদড় পরিচিত একটি প্রাণী। অঞ্চলভেদে নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো ভোঁদড় দেখেননি। ভোঁদড়ের নাম হয়তো শুনেছেন। ছড়ায় পড়েছেন, ‘আয় রে আয় টিয়ে/ নায়ে ভরা দিয়ে/ না’ নিয়ে গেল বোয়াল মাছে/ তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে/ ওরে ভোঁদড় ফিরে চা/ খোকার নাচন দেখে যা।’

সুন্দরবন তথা খুলনা অঞ্চলে সাধারণত ভোঁদড় দেখা যায়। তবে আগের মতো নেই। সংখ্যা কমছে। রাজশাহীতে পদ্মায় কদাচিৎ ভোঁদড়ের দেখা মেলে। তবে রংপুর অঞ্চলের জেলাগুলোয় ভোঁদড় আছে—এমন কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। এবার বিলুপ্তির পথে থাকা প্রাণীটির দেখা মিলেছে রংপুরে, তিস্তা নদীতে।

তিস্তায় ভোঁদড়ের দেখা পাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। ঘটনাটি গত ১৬ ডিসেম্বরের। রৌদ্রোজ্জ্বল সেই দিনে গিয়েছিলাম তিস্তা দর্শনে। উদ্দেশ্য, পাখির ছবি তোলা আর তিস্তার এখনকার অবস্থা নিজের চোখে দেখে আসা। সঙ্গী আরেক আলোকচিত্রী রাকিন জহির। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর পয়েন্ট আমাদের গন্তব্য।

তিলা হাঁস, লালঝুঁটি ভুতি হাঁস, মেটে দেশি হাঁস আর চখাচখির ছবি তুলতে তুলতে তিস্তা দর্শন হচ্ছিল। মহিপুর ছেড়ে বেশ খানিকটা উজানে চলে গিয়েছিলাম। ঠিক হয়, ফেরার পথে আর নৌকা নয়; গোডাউনের হাট নামক জায়গায় নেমে সড়কপথে ফেরা হবে।

নৌকা গোডাউনের হাটের কাছে যেতেই আরেক মাঝি খাইরুলের ফোন। বললেন, ‘ভাই, বেজির মতো কী যেন পানিত ডোবে, ফির ভাসে। ফির শুকনা জাগাত আসি বইসে। ঠ্যাং ছোট ছোট।’ শুনেই বুঝতে পারি, এটা ভোঁদড় ছাড়া আর কিই-বা হতে পারে। কিন্তু তিস্তায় ভোঁদড়!

নৌকার মাঝিকে মহিপুর পয়েন্টে যেতে বললাম। তখন সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে। সেতুর পিলারের নিচের যেই অংশটা পানির ওপরে ভেসে আছে, সেখানেই গোল হয়ে শুয়ে ছিল ভোঁদড়টি। নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। দেখে মনে হলো, মানুষকে খুব একটা ভয় পাচ্ছে না।

এরপর ভোঁদড়টি নিজে নিজেই পানিতে নেমে গেল। আবার একটু পরে ওপরে উঠে এল। একবার ডুবে ডুবে একটু দূরে গেল। তারপর চরের ওপর উঠল। যতবার উঠছে, ততবার ভোঁদড়টি মুখ, মাথা বালুতে মেখে নিচ্ছে। আমরা ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিলাম। খাইরুল জানালেন, ভোঁদড়টি আগের দিন থেকেই ওখানে আছে। দুটি ভোঁদড় দেখা গেছে।

খাইরুল মাঝি প্রায় তিন দশক ধরে তিস্তায় নৌকা চালান। আমিও কমবেশি ১৫ বছর ধরে তিস্তা নিয়ে কাজ করছি। বছর পাঁচেক হলো তিস্তায় যাই পাখির ছবি তুলতে। আমরা কেউই এর আগে কখনো তিস্তায় ভোঁদড় দেখিনি। কেউ দেখেছে, এমনটাও শুনিনি। তিস্তায় সচরাচর শুশুক দেখা যায়। সম্প্রতি আমিও বেশ কয়েকটি দেখেছি। কখনো কখনো ‘বাগাড়’ নামে বিশালাকারের মাছ তিস্তায় চলে আসে। কিন্তু কোনো দিন ভোঁদড় দেখিনি, ভোঁদড় দেখার কথা শুনিওনি।

আমরা ঘুরে আসার পরদিন রংপুরের দুই আলোকচিত্রী প্রকৌশলী ফজলুল হক আর সাহিত্যকর্মী রানা মাসুদ ভোঁদড় খুঁজতে খাইরুল মাঝিকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেদিন আর ভোঁদড়ের দেখা পাওয়া যায়নি।

সুন্দরবন তথা খুলনা অঞ্চলে আগে ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করা হতো। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট ছোট পানির প্রবাহে ভাটার সময় কখনো কখনো ভোঁদড় দেখা যায়। সম্প্রতি সুন্দরবনের করমজলে গিয়ে ভোঁদড়ের দেখা পাইনি। কিন্তু এবার এমন এক জায়গায় ভোঁদড় দেখলাম, যেখানে আসলে প্রাণীটির দেখা পাওয়ার কথা নয়।

ছবি দেখে পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান বলেন, এটি এ দেশের এক বিরল ও মহাবিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী মাছ নেউল, মসৃণ উদ বা ভোঁদড়। ইংরেজি নাম স্মুথ-কোটেড ওটার। এগুলোর দেহ বেশ বলিষ্ঠ ও লম্বা। লম্বায় দেহ ৫৯ থেকে ৭৯ সেন্টিমিটার ও লেজ ৩৭ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার হয়। ওজন ৭ থেকে ১১ কেজি। এ দেশে প্রাপ্ত তিন প্রজাতির ভোঁদড়ের মধ্যে আকারে এরা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সুন্দরবনে বর্তমানে যে ভোঁদড়টি দেখা গেল, সেটি হলো ছোট উদ বা উদবিড়াল (স্মল-ক্লড অটার), যা বিশ্বের ক্ষুদ্রতম ভোঁদড়।

আমরা নদী মেরে ফেলছি। জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করছি। মানুষ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোঁদড়ের মতো অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হতে বসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিস্তার ভোঁদড়টি যমুনা নদী দিয়ে উজানের দিকে এসেছে বা ভারত থেকে ভাটির দিকে চলে এসেছে। যেখান থেকেই আসুক না কেন, এর পরিণতি ভালো হোক। ভোঁদড়টি ভালো থাকুক।