লালচে মাথার হাঁসেরা

রাঙামুড়ি হাঁসের ঝাঁক। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরেছবি: লেখক

ভটভট শব্দে হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাট থেকে মেঘনা নদীর বুক চিরে ছুটে চলেছে ইঞ্জিনের নৌকা। নদীতে অসংখ্য জেলে ইলিশ ধরছেন। জাহাজমারা ঘাট পার হয়ে বিশাল এক চরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নদী ও খালের মোহনায় লাল মাথায় হলদে সিঁথিযুক্ত হাঁসের ঝাঁক ভেসে বেড়াতে দেখলাম; কিন্তু নৌকা ওদের কাছাকাছি আসতেই সদলবলে উড়ে গেল। কী চমত্কার সে দৃশ্য!

নৌকা কিছুটা সামনে এগোতেই আবারও ওরা পানিতে নামল। প্রতিটি খালের মোহনায় ২০ থেকে ১৩০টি পাখির ঝাঁক চোখে পড়ল। নিঝুম দ্বীপ পর্যন্ত এ রকম সাত-আটটি খালেই ওদের ছাড়া অন্য কোনো হাঁস দেখলাম না। ৭ জানুয়ারি ২০১৬ সালের ঘটনা এটি। পরদিন পাশের দমার চরেও একই প্রজাতির আরও হাঁস দেখলাম।

লাল মাথায় হলদে সিঁথিযুক্ত পরিযায়ী হাঁসগুলোর নাম লালশির। ওরা ছাড়াও প্রতি শীতে বেশ কিছু প্রজাতির লাল, লালচে, গাঢ় লাল বা খয়েরি মাথার হাঁস দেশের হাওর-বাঁওড়-নদী-খাল-জলাভূমিতে পরিযায়ী হয়। বেশির ভাগেরই মূল আবাস (যেখানে প্রজনন করে ও ডিম-ছানা তোলে) ইউরোপ, রাশিয়া (সাইবেরিয়া) ও মধ্য এশিয়া। ওদের মাথার এই লাল পালক কিন্তু শুধু পুরুষেই দেখা যায়, স্ত্রীতে নয়; ব্যতিক্রম লালমুড়ি হাঁস। এখানে ওদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি।

লালশির (Eurasian Wigeon): ছোট লালশির বা সিঁথি/হলদে সিঁথি/দুবরাখাওরি হাঁস নামেও পরিচিত। ওরা এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী হাঁস। মূল আবাস আইসল্যান্ড, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর ইউরোপ, দক্ষিণ রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি। শীতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। হাঁসা-হাঁসিনির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ৪২ থেকে ৫২ সেন্টিমিটার। ওজন ৭০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ৭৩ গ্রাম।

রাঙামুড়ি হাঁস (Red-crested Pochard): সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখিটি বজ্রমুড়ি/রাঙাঝুঁটি হাঁস নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে বড় রাঙামুড়ি হাঁস; অবশ্য অনেকে হাঁসাকে হিরো হাঁস ও হাঁসিকে ছোবড়া হাঁস নামেও ডাকেন। ওদের ঝুঁটি দেখলে মনে হবে যেন মাথায় টুপি পরে আছে। দক্ষিণ ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও মঙ্গোলিয়ার আবাসিক পাখিটি ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফ্রিকায় পরিযায়ী হয়। লম্বায় ৫০ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৮৩০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ৪০০ গ্রাম।

লালমুড়ি হাঁস (Common Pochard): লালচে মাথার দুর্লভ পরিযায়ী হাঁসটি পশ্চিমবঙ্গে রাঙামুড়ি হাঁস নামেও পরিচিত। ইউরোপ ও উত্তর এশিয়ার আবাসিক হাঁসটি ভারতীয় উপমহাদেশ, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় পরিযায়ন করে। দেহের দৈর্ঘ্য ৪২ থেকে ৪৯ সেন্টিমিটার। ওজন ৪৬৭ গ্রাম থেকে ১ কেজি ২৪০ গ্রাম।

বড় ভূতিহাঁস (Baer’s Pochard): এটি এ দেশের বিরল ও মহাবিপন্ন পরিযায়ী পাখি। ২০২২ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরে বেশ দূর থেকে দেখেছিলাম। আসামে বলে বড় কালিমুড়ি হাঁস। সিলেট বিভাগের টাঙ্গুয়া ও হাকালুকি হাওরে প্রতিবছর অল্পসংখ্যক আসে। অতীতে ঢাকা বিভাগেও দেখা যেত। দৈর্ঘ্য ৪১ থেকে ৪৭ সেন্টিমিটার। ওজন ৫০০ থেকে ৭৩০ গ্রাম।

রাঙাদিঘেরি (Ferruginous Duck): সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী হাঁসটির অন্য নাম লালবিগড়ি, ভূতিহাঁস বা সাদাআঁখি/ছোট ভূতিহাঁস। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও উত্তর এশিয়ার আবাসিক হাঁসটি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। লম্বায় ৩৮ থেকে ৪২ সেন্টিমিটার। ওজনে ৪৬৪ থেকে ৭৩০ গ্রাম।

লেনজা হাঁস (Northern Pintail): খয়েরি মাথা ও লম্বা লেজের সুদর্শন সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী হাঁসগুলো কালদিঘেরি, দিগহাঁস, শোলবড়, শোলঞ্চ বা পিনপুচ্ছ নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে বড় দিগর। আলাস্কা, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার এই বাসিন্দারা শীতে এদেশের নদী-হাওর-বিলের মূল আকর্ষণ।

সোনাদিঘেরি (Common Teal): বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র আকারের হাঁসটি এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি। পাতারি/পেরি/ সবুজডানা হাঁস, নারৈব বা তুলসীবিগির (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। ওদের মাথা পুরোপুরি লালচে না হলেও গাল, ঘাড়, গলা ও মাথার চাঁদি খয়েরি লাল। চোখের পেছন থেকে মাথার দুই পাশ চকচকে সবুজ। এই লাল-সবুজ বন্দী হয়ে রয়েছে হলুদ রেখায়। শীতে উত্তর গোলার্ধের বাসিন্দাদের এদেশের নদী-হাওর-বিলে দেখা যায়। লম্বায় ৩৪ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২৫০ গ্রাম থেকে ৪৫০ গ্রাম।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান:পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সাবিশেষজ্ঞ