গোলাপের রং সবুজ

টাঙ্গাইলের সখীপুরে কবি নজরুল পার্কে ফুটেছে সবুজ গোলাপ
ছবি: লেখক

সবুজ গোলাপ কি আসলে গোলাপ? ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে সবুজ রঙের গোলাপগুলো দেখার পর এ প্রশ্নটাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। শুধু আমারই না, এ রকম প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক রোজ সোসাইটির মাস্টার রোজারিয়ান সুজানে হর্নও। নানা বিতর্কের পরও একে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে আদিম গোলাপ হিসেবে। সুজানে তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এই গোলাপকে ভালোবাসতে পারেন, আবার ঘৃণাও করতে পারেন।’

সত্যিকার গোলাপের মতো এর সৌন্দর্য নেই। তবু প্রাচীনকালে এই গোলাপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেকালে এই সবুজ রঙের গোলাপকে বিবেচনা করা হতো উর্বরতা, সমৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের প্রতীক হিসেবে। এমনকি পাশ্চাত্যে কারও কারও কাছে প্রাচীনকালে এই গোলাপ ছিল সুখ্যাতি ও ব্যবসায়িক সাফল্যের প্রতীকও। তাই কেউ কেউ অতীতে বাগানে এই গোলাপগাছ লাগাতেন।

আমি অবশ্য কোনো গাছকেই ঘৃণা করতে শিখিনি। বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীর বুকে প্রতিটি গাছকেই মানুষের উপকার করার কোনো না কোনো দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন। তাই রূপে মুগ্ধ না হয়ে সবুজ গোলাপের ভিন্নতার কারণে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান থেকে পাঁচটি চারা নিয়ে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের সখীপুরে কবি নজরুল পার্কে লাগাই। তেমন কোনো যত্ন নেওয়া হয়নি। তবুও এই কয়েক মাসের মধ্যেই গাছগুলো বেশ বেয়াড়াভাবে ঝোপাল হয়ে উঠেছে, আর গাছ ভরে অবিরামভাবে ফুটে চলেছে সবুজ রঙের গোলাপ।

গোলাপের মধ্যে এই গোলাপ একেবারেই আলাদা, সচরাচর দেখা যায় না। গাছ ঠিকই গোলাপগাছের মতো, পাতাও গোলাপপাতার মতো। কিন্তু ফুল দেখে কখনোই গোলাপ ফুল বলে মনে হয় না। গোলাপ ফুলের যেমন সুন্দর কোমল পাপড়ি থাকে, সবুজ গোলাপের তেমনটা না। ডালের মাথায় ফুল ফোটে, তবে সে ফুলের পাপড়িগুলো দেখতে হালকা সবুজ পাতার মতো, পাপড়িরও আসল গোলাপের মতো কোমলতা নেই, কিছুটা শক্ত, নেই গোলাপের কোনো ঘ্রাণ, ডালপালায় নেই কাঁটা। ফুল বলতে যা দেখছি, সেগুলোতে ফুলের আসল কোনো পাপড়িই নেই, তবে বৃতির মতো অঙ্গ আছে।

গাছ বেশ ঝোপাল। গাছে তেমন রোগ হয় না, খরা সহ্য করতে পারে, রোদে ভালো হয়। প্রায় সারা বছরই গাছের মাথা ভরে প্রচুর ফুল ফোটে। প্রকৃত ফুল নয় বলে এর বীজ হয় না, সংকরায়ণও করা যায় না, অঙ্গজ উপায়ে চারা তৈরি করতে হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, এই গোলাপ আসলে একধরনের কৌলিতাত্ত্বিক অসংগতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে। তাই এর কিছু বৈশিষ্ট্য অপূর্ণ ও প্রকৃত গোলাপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবু গবেষকেরা এই গোলাপকে গোলাপ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও রোজেসি পরিবারের রোজা গণের একটি প্রজাতি হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে Rosa chinesis ‘viridiflora’। চীনে এই সবুজ গোলাপের উৎপত্তি। একসময় চীনা রাজাদের উদ্যানের বাইরে অন্যদের জন্য এ গোলাপের চাষ ছিল নিষিদ্ধ।

ভারতে হিন্দি ভাষায় এ গোলাপকে ডাকা হয় হরা গোলাপ নামে। ভারতে ১৭৪৩ সাল থেকে সবুজ গোলাপের গাছ লাগানো হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের বেমব্রিজ অ্যান্ড হ্যারিসন নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১৮৫৬ সালে এর চাষ ও চারা বিক্রি করা শুরু করে। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সোহেলা সরকার বলেন, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের গোলাপবাগানে প্রায় তিন শ জাতের গোলাপ আছে, এর মধ্যে সবুজ গোলাপ একটি জাত। তখনকার পরিচালক এম এ হান্নান ১৯৮০ সালে বিদেশ থেকে প্রথম সবুজ গোলাপ এনে ওই গোলাপ বাগানে লাগান। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই গোলাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সবুজ গোলাপের গাছ আছে গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফুল বিভাগের বাগানেও। গোলাপপ্রেমিকেরা বৈচিত্র্যের জন্য সবুজ গোলাপ লাগাতে পারেন।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ প্রকৃতিবিষয়ক লেখক