অতি বিরল নীল-কপালি লালগির্দি পাখির ছবি তুলে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকে রাজশাহী ফিরতে রাত হয়ে গেল। পরদিন সকালে পক্ষী আলোকচিত্রী ইমরুল হাসানসহ আরেকটি বিরল পাখির সন্ধানে অনিক মাঝির নৌকায় উঠলাম রাজশাহীর পুলিশ লাইনের বটতলা ঘাট থেকে। আজ (গত ১৭ ফেব্রুয়ারি) বেশ কটি পাখির খোঁজে পদ্মা নদীর তিনটি পয়েন্টে ঘোরাঘুরি করব। প্রথমেই যাচ্ছি বিরল ও তথ্য অপ্রতুল জলজ পাখিটির খোঁজে। যদিও পাখিটিকে যেখানে দেখা গেছে, সেই জায়গাটি বটতলা ঘাট বা টি-বাঁধের ঠিক উল্টো পাড়ের কাছে। কিন্তু কিছুটা ঘুরে যেতে হলো বলে জায়গামতো পৌঁছাতে আধঘণ্টার বেশি সময় লাগল।
পাখিটির খোঁজে ২০১৯ সালের ৬ ও ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহীর পদ্মা নদীতে দুবার অভিযান চালিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। অবশেষে ৩০ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা ভাই ও ডা. নূর-ই-সৌদসহ কিছু পক্ষিবিদ পাখিটির খোঁজ পেলেন। এরপর পরপর দুবছর পাখিটিকে পদ্মার চরে দেখা গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বারবার গিয়েও ওর দেখা পাইনি। তবে আজ আমি বেশ আশাবাদী। কারণ, এক দিন আগেও অনিক মাঝি পাখিটিকে দেখেছেন। তাই আমি বেশ উত্তেজিত।
বটতলা ঘাট থেকে রওনা হয়ে বিরল পাখিটির কাছে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত ছোট পানকৌড়ি, বড় খোঁপা ডুবুরি, সাদা খঞ্জন, চা-পাখি, চখাচখি, মেঠো আবাবিল, মালা চ্যাগা, জিরিয়া ও ছোট পানলৌয়ার দেখা পেলাম। এরপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অবসান হলো দীর্ঘ সোয়া চার বছরের অপেক্ষা। ঠিক সকাল নয়টা ২৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ড চোখের সামনে ভেসে উঠল তিনটি পাখির মাথার অবয়ব। ধীরে ধীরে নৌকা সামনে এগোচ্ছে আর পাখিগুলোর চেহারা স্পষ্ট হচ্ছে। একসময় ওরা আমাদের নৌকার বেশ কাছে চলে এল। মনকে শান্ত করে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে সমানে শাটারে ক্লিক করে গেলাম। ১২ মিনিট ২ সেকেন্ডে মোট ৩৩৮টি ক্লিক করলাম। নিজের পক্ষিতালিকায় আরেকটি নতুন প্রজাতি যোগ করে দ্বিতীয় গন্তব্যের দিকে রওনা হয়ে গেলাম।
দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর খুঁজে পাওয়া পাখিটি এ দেশের অনিয়মিত ও তথ্য অপ্রতুল পরিযায়ী পাখি কালো-গলা ডুবালু বা ডুবুরি (ব্ল্যাক-নেকড গ্রিব)। পডিসিপেডিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Podiceps nigricollis। শীতে সিলেট বিভাগের হাওর ও ঢাকা বিভাগের দুটি পুরোনো রেকর্ড ছাড়া রাজশাহীর পদ্মা নদীতে এ নিয়ে চারবার দেখা গেল। পাখিটির মূল আবাস উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরেশিয়া, ভারতের উত্তর–পূর্ব ও উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল এবং পাকিস্তান।
কালো-ঘাড় ডুবালু কালো খোঁপা ও লাল চোখের ছোট আকারের ডুবুরি। দেহের দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৩৪ সেন্টিমিটার। ছোট ডুবালু থেকে কিছুটা বড়। প্রজননকালে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরটা কালচে ও নিচটা মরচে লাল ধারণ করে। মাথা ও ঘাড় হয় কালো; চিবুক হয় সোনালি-হলুদ। ঠোঁট হয় কুচকুচে কালো। অন্যদিকে প্রজননকাল বাদে অন্য সময় ওদের দেহের ওপরের পালকগুলোর রং গাঢ় থাকে। পেটের দিকটা হালকা ধূসরাভ-সাদা, ঘাড় ময়লাটে ধূসর। কানের কাছে সাদা বাঁকা চাঁদের মতো দাগ দেখা যায়। কিঞ্চিত ওপরের দিকে ওঠানো ঠোঁটটি কালচে-হলুদ। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল কালো। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পালক হলদে-ধূসর ও চিবুক সাদা।
কালো-ঘাড় ডুবালু ভাসমান জলজ উদ্ভিদে ভরা জলাভূমিতে থাকতে পছন্দ করে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। অগভীর পানিতে ডুব দিয়ে অথবা সাঁতার কেটে ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙাচি, জলজ পোকামাকড় ও চিংড়িজাতীয় প্রাণী খুঁজে খায়। ডুব দিতে অত্যন্ত দক্ষ পাখিটি মানুষ দেখলে ওড়ার চেয়ে বরং ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকে। একটিমাত্র ‘ওওয়েহ’ শব্দে ডাকে।
মে থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় পুরুষ পাখি মনোরম ‘পু-ঈ-চক—পু-ঈ-চক—’ শব্দে ডাকে। জলাভূমির কাছে ঘাসের ডাঁটার স্তূপ করে বাসা তৈরি করে। ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। ডিম থেকে সদ্য ফোটা ছানারা বেশ ইঁচড়ে পাকা। নিজেরাই নিজেদের খাবার খুঁজে খায়। মাঝেমধ্যে মায়ের পিঠে চড়ে বেড়ায়।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সাবিশেষজ্ঞ