সাড়ে ৫০০ বছরের মাধবীলতা

যশোরের বেনাপোল এলাকায় পাটবাড়ী আশ্রমে ৫৫০ বছরের পুরোনো মাধবীলতাছবি: লেখক

মাধবীলতার বয়স ৫৫০ বছর! চমকপ্রদ খবর বৈকি। এমন একটি আনন্দময় খবরের সূত্রধর বৃক্ষপ্রেমী কেকা অধিকারী। তিনি জানালেন, যশোরের বেনাপোল এলাকায় হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ী আশ্রমে গেলেই দেখা মিলবে এই ঐতিহ্যবাহী উদ্ভিদের। গত বছর তিনি খোঁজটি জানিয়েছিলেন। কিন্তু শহুরে মেকি ব্যস্ততার আড়ালে চাপা পড়েছিল মাধবীপ্রেমের সব উচ্ছ্বাস। এ বছর আর তিনি হাল ছাড়লেন না। সেখানে যাওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করে রীতিমতো তাড়া দিলেন। অবশেষে একদিন রাজধানীকে বিদায় জানিয়ে উপস্থিত হলাম যশোরে। সকালেই বেরিয়ে পড়ি বেনাপোলের উদ্দেশে। সঙ্গী হলেন স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা মো. আহসানুল কবীর। নন্দিত মাধবীকে ছুঁয়ে দেখার এমন বিরল একটি মুহূর্তকে স্পর্শ করতে তাঁর আগ্রহেরও কমতি ছিল না।

আশ্রমের সুরম্য তোরণ পেরিয়ে কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ল একটি পরিণত তমালতরু। পাশের উৎকীর্ণ লিপির তথ্যমতে, অদ্বৈত আচার্য নামের এক ব্যক্তি ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দে হরিদাস ঠাকুর নামের এক সিদ্ধপুরুষের আগমনে আনন্দিত হয়ে এই তমালগাছ রোপণ করেন। গাছটির বিক্ষিপ্ত ডালপালায় বয়সের ধকল স্পষ্ট। কাটা পড়েছে মোটা একটি ডাল। অন্য ডালপালাগুলো জীর্ণশীর্ণ, হতশ্রী ও জরাগ্রস্ত। তবু কচি পাতার উচ্ছ্বাসে সপ্রাণ গাছটি। তমালতলায় দাঁড়িয়ে যখন গাছটির হৃদয়ভাষা অনুভব করার চেষ্টা করছি, তখনই নাটমণ্ডল থেকে কানে ভেসে এল নামকীর্তনের সুললিত সুরধ্বনি। কয়েক পা এগোতেই পরম কাঙ্ক্ষিত মাধবীর সুবিশাল পরিসর স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুহূর্তেই পুলকিত হলো মন। অবশেষে ৬০০ বছরের বিরল এক ঐতিহ্যের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেলাম। তমালের ঠিক বিপরীত অবস্থানেই রয়েছে মাধবীলতাটি। নাটমণ্ডলের ছাদ বেয়ে লাগোয়া আম, শিরীষ, বেলসহ কয়েকটি গাছেও ছড়িয়ে পড়েছে মাধবীলতা। ছাদের প্রায় পুরোটা জুড়েই মাধবীর বিস্তার। অবাক হই, সারা দেশে ভুল করে মধুমঞ্জরিলতাকে যখন মাধবী বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন এমন পুরোনো গাছটি কীভাবে সঠিক পরিচয়ে এখানে বেঁচে আছে!

মাধবীতলায় উৎকীর্ণ নামলিপির তথ্যমতে, আনুমানিক ১৪৭১ সালে হরিদাস ঠাকুর বেনাপোলের যে স্থানে আসেন, সে স্থানটিই পরবর্তীকালে পাটবাড়ী নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি মাধবীলতাটি সামনে রেখে একটি ভজন কুটির নির্মাণ করেন। এবং মাধবীতলায় প্রতিদিন হরিনাম জপ করতেন। উল্লিখিত সাল অনুসারে বর্তমানে গাছটির বয়স প্রায় ৫৫০ বছর। একাধিক কাণ্ডের সম্মিলিত অবয়বে গাছটিতে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। বোঝা গেল, আশ্রম কর্তৃপক্ষ বেশ যত্নেই রেখেছে গাছটিকে। ফাল্গুনের মাঝামাঝি ফুলের জৌলুশ কমে গিয়ে ডালপালায় হালকা আবরণের ফলগুলো শোভা পাচ্ছে।

মাধবী (Hiptage benghalensis) নিতান্তই দুষ্প্রাপ্য। নগর উদ্যানে গাছটি সংখ্যায় যেমন কম, অন্যদিকে স্বল্পস্থায়ী প্রস্ফুটনও মাধবীকে কম চেনার অন্যতম কারণ। মূলত রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই মাধবীর সঙ্গে আমাদের সখ্য। খ্যাতির পেছনেও অনবদ্য ভূমিকা তাঁর। তিনি লিখেছেন,Ñ‘বসন্তের জয়রবে/ দিগন্ত কাঁপিল যবে/ মাধবী করিল তার সজ্জা।’ ফুলটি চটজলদি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যায়। তিনি লিখলেন,Ñ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে/ এসে হেসেই বলে “যাই যাই যাই”।’ মাধবীর প্রতি কবির পক্ষপাত মূলত মধুগন্ধের জন্যই। তিনি লিখেছেন,Ñ‘মাধবী বনের মধুগন্ধে মোদিত মোহিত/ মন্থর বেলায়।’

কাষ্ঠললতার এই গাছ পত্রমোচি। পাতা ১০ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার লম্বা, পুরু ও বিন্যাস বিপ্রতীপ। ফুল বসন্তের বার্তাবহ। প্রায় নিষ্পত্র ডালে পাঁশুটে সাদা রঙের গুচ্ছবদ্ধ সুগন্ধি ফুলগুলো ফোটে। ফুলের পাপড়ির সংখ্যা ৫, ৪টি সমান ও সাদা, ১টি ছোট ও হলুদ। ভারি সুগন্ধি, ভ্রমরাও উতলা হয়। সিলেটের বনে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। তবে এখন সংখ্যায় খুবই কম। সবার ভালোবাসায় বেঁচে থাকুক মাধবীলতা।