বিলুপ্তপ্রায় প্যারাপাখির বড় আশ্রয় এখন সুন্দরবন

মানুষের উপদ্রব আর উন্নয়নকাজের চাপে বিলুপ্তির পথে এশীয় প্যারাপাখি। হাঁসজাতীয় এই প্রজাতিটি একসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেই নিয়মিত দেখা যেত। গত দুই দশকে এদের আবাসস্থল দ্রুত কমছে। এখন বিশ্বে এই পাখির সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩০২টি; যার ১৬০টিই রয়েছে বাংলাদেশের সুন্দরবনে। বাকি যে কটি আছে, তাদের কম্বোডিয়ায় কালেভদ্রে দেখা যায়। অন্যদিকে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম মহা বিপন্ন প্রাণী বাঘ রয়েছে ৩ হাজার ৮৯০টি।

বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে প্যারাপাখি। বাংলাদেশের সুন্দরবনই এখন এই পাখির বড় আশ্রয়স্থল। সুন্দরবনের ছিটাকটকা এলাকায়
ছবি: সায়েম উ আহমেদ

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পাখিবিজ্ঞান সাময়িকী ফর্কটেইল-এর জানুয়ারির সংখ্যায় একটি গবেষণা নিবন্ধে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, বন্য প্রাণিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সমিতি এবং মালয়েশিয়ার মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও পাখি বিশেষজ্ঞদের একটি দল যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে। বন্য প্রাণী ও পাখিবিষয়ক চারটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে, ম্যানগ্রোভনির্ভর এই পাখিকে মহা বিপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা জরুরি।
ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্বে প্যারাপাখির অবস্থা ও বিস্তার তুলে ধরা হয়েছে। এতে জানানো হয়, বাংলাদেশের সুন্দরবনে সর্বোচ্চ ১৬০টি প্যারাপাখি টিকে রয়েছে। কম্বোডিয়ায় এই প্রজাতির পাখি ৬৪টি, মিয়ানমারে ৪০টি, লাওসে ৩০টি, ভিয়েতনামে ৬টি এবং ভারতে ৪টি পাখি রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে এ পাখির প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

তবে বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৭ সালে এই পাখির সংখ্যা নিয়ে জরিপ হয়েছে। বাকি দেশগুলোয় জরিপ হয়েছে ১৯৯১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। ফলে গবেষক দলের ধারণা, এই সময়ের মধ্যে ভিয়েতনাম ও ভারত থেকেও প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সায়েম ইউ চৌধুরী। তিনি সুন্দরবনে এই পাখির ওপর এক যুগ ধরে গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্ত প্রমাণ করে, এই পাখি এখন শুধু বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়াতেই প্রজনন করে। বাকি দেশগুলো থেকে এরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক জরিপ ও প্রকাশিত গবেষণাগুলো মূল্যায়ন করে দেখা গেছে, অনন্য এ জলজ পাখিটি বিলুপ্তির মহা বিপদের মধ্যে রয়েছে।
পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশীয় প্যারাপাখির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তা পানি, মাটি ও গাছ—এই তিন জায়গায়ই বিচরণ করতে পারে। শক্ত পা আর নখ থাকায় এরা গাছ বেয়ে উঠতে পারে। এই বৈশিষ্ট্য বিশ্বের খুব কম পাখির রয়েছে। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে, গাছের মধ্যে এরা ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার স্থানের আশপাশের খালে এরা সাঁতরে বেড়ায়।

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আবাসস্থলে মানুষের উপদ্রব বাড়লে এই পাখিরা সেখানে আর ডিম পাড়ে না। একসময় পাখিটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমতলে ব্যাপকভাবে বিচরণ করত। এশিয়ার উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকার বনভূমির নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে গত কয়েক দশকে নানা স্থাপনা নির্মাণ, পর্যটন ও শিল্পায়ন হয়েছে। ফলে উপদ্রব বাড়ায় পাখির প্রজাতিটিও ওই সব এলাকা থেকে সরে যাচ্ছে।

কম্বোডিয়ায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সমিতির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও গবেষণা নিবন্ধটির সহলেখক সিমন মাহুদের মতে, ‘বসতি ধ্বংস এবং মানুষের উপদ্রব এই পাখি ও নদীর বাস্তুতন্ত্রের অংশ অন্যান্য পাখির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে প্যারাপাখিকে বাঁচাতে হলে এর বাসস্থানগুলো রক্ষা করতে হবে।’

সায়েম ইউ চৌধুরীর গবেষণায় দেখা গেছে, প্যারাপাখির ডিম পাড়ার স্থানটি গাছের খুব বেশি উঁচুতে হয় না। ফলে সুন্দরবনের জেলে ও পর্যটকেরাও এই পাখির ডিম নিয়ে যান। তবে এই বিপদ-আপদের মধ্যেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বন পাখিটির জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।


বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনালের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও গবেষণাপত্রের সহলেখক জোনাথন ইমেস বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নদীগুলোয় প্যারাপাখি একসময় অতিপরিচিত পাখি ছিল। আশির দশকের শুরুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁর প্যারাপাখি পর্যবেক্ষণের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘আমার মতো অনেকেই প্যারাপাখি দেখার জন্য তখন মালয়েশিয়ার তামান নেগ্রা এলাকায় যেত। এখন তাদের আর সেখানে দেখা যায় না।’

গবেষকদের সুপারিশ

এশীয় প্যারাপাখিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে গবেষকেরা এই পাখির সবচেয়ে ভালো আবাসস্থল বাংলাদেশের সুন্দরবন সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে, পূর্ব সুন্দরবনের স্বাদু ও নোনাপানির মিশ্রণে গড়ে ওঠা ব্রাকিশ ওয়াটার–সমৃদ্ধ এলাকা এদের বসবাসের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। সেখানকার খাল ও তার পাড়ের এলাকায় এরা ডিম পাড়ে ও বিচরণ করে। কাজেই ওই সব এলাকা সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছেন গবেষকেরা।


এ ছাড়া তাঁরা কয়েকটি সুপারিশও করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রজনন মৌসুমে এই পাখির বাসস্থান এলাকায় মানুষের যাতায়াত সীমিত করা এবং ওই সব এলাকায় সূক্ষ্ম সুতার মাছ ধরার জাল নিষিদ্ধ করা। কারণ, এসব জালে আটকা পড়ে অনেক পাখিই মারা পড়ে। এ ছাড়া গবেষকেরা সমতলের জলাভূমির বাসস্থানগুলো রক্ষায় পদক্ষেপ বাড়ানোর ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন।