২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বনায়নে পাউবোর তোড়জোড়ে আপত্তি পরিকল্পনা কমিশন ও বন বিভাগের

ফাইল ছবি

দেশের ৮টি বিভাগের ৫৮ জেলায় খাল, বাঁধ ও নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য বনায়ন করতে চায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ জন্য সরকারের কাছে তারা ২৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। কিন্তু পাউবো কেন বনায়নের কাজ করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন ও বন বিভাগ। কমিশন বলেছে, গাছ লাগানোর এখতিয়ার বন বিভাগের। বনায়ন যদি করতে হয়, সেটি বন বিভাগের মাধ্যমে করতে হবে। একই মত বন বিভাগেরও। অন্যদিকে পাউবো বলছে, তারা বন বিভাগের মতামত নিয়ে বনায়ন করবে। এ নিয়ে চলছে ত্রিমুখী চিঠি চালাচালি।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নদীভাঙন কমিয়ে আনার পাশাপাশি বাঁধ সংরক্ষণের জন্য গাছ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সে জন্য পাউবোর আওতাধীন দেশের ৮টি বিভাগের ৫৮ জেলায় যেসব বাঁধ, খাল ও নদী তীর আছে, সেসব স্থানে গাছ লাগানো হবে। ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরে এ–সংক্রান্ত একটি প্রকল্প তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে পাউবো। ‘বাঁধ, নদী তীর ও খাল রক্ষাকল্পে সবুজময়’ শিরোনামের প্রকল্পটি সরকারি টাকায় বাস্তবায়ন করতে চায় সংস্থাটি। এ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন প্রজাতির ৫৬ লাখ ২৬ হাজার ৬৪৬টি চারা রোপণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাব পাওয়ার পর কমিশন তাদের মতামতে জানিয়েছে, অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুসারে, বনায়নের কাজ করে থাকে বন বিভাগ। এ বিষয়ে তারা অভিজ্ঞ। সারা দেশে বনায়নের কাজের এখতিয়ার (ম্যান্ডেট) বন বিভাগের। পানি উন্নয়ন বোর্ড বর্তমানে খাল খনন, বাঁধ নির্মাণ ও নদীর তীর সংরক্ষণ করতে গিয়ে সীমিত পরিসরে বন বিভাগের পরামর্শ নিয়ে গাছ লাগিয়ে থাকে। তাই বলে সারা দেশে খাল, বাঁধ ও নদীর তীর সংরক্ষণে বনায়ন করার মতো অভিজ্ঞতা পাউবোর নেই। বনায়ন যদি বন বিভাগকে দিয়ে করানো হয়, তাহলে কেবল প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রক্রিয়া করা যেতে পারে বলে জানিয়েছে কমিশন।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের পানিসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছি বনায়ন আপনাদের কাজ নয়। কেন আপনারা এ কাজ করতে চান। এটা বন বিভাগের কাজ। তাদের জবাব ছিল, বাঁধ, নদী তীর ও খালের জায়গা তাদের। বন বিভাগের মতামত নিয়ে তারা বনায়ন করবে। তখন আমরা বলেছি, যদি বন বিভাগকে দিয়ে সবুজময় করা হয়, তাহলে কমিশনের আপত্তি নেই। কিন্তু এ কাজ পাউবো করতে পারে না। এটা তাদের এখতিয়ার নয়। আমরা সেটি জানিয়ে দিয়েছি।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বাঁধের স্থায়িত্ব রক্ষার পাশাপাশি ভূমিক্ষয় কমিয়ে আনতে তারা বাঁধের ওপর বনায়ন করতে চায়। বাঁধের ঢাল ও খালের পাড় রক্ষা করতে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজময় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধক তৈরি, বনজ সম্পদ বাড়ানো, ফলের চাহিদা পূরণ এবং পাখির অভয়ারণ্য তৈরির জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো।

তবে প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গাছের চারা উৎপাদন ও রোপণে যে টাকা ধরা হয়েছে, তা বন বিভাগের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে তিন গুণ বেশি। পাউবো তাদের প্রস্তাবনায় নারকেলের চারা একক দর (সার্কেলভিত্তিক) প্রস্তাব করেছে ৪১০ টাকা থেকে ৪৫৫ টাকা। ম্যানগ্রোভ চারার খরচ (সার্কেলভিত্তিক) একক দর প্রস্তাব করা হয়েছে ১৮০ থেকে ১৮৮ টাকা। তালের একক দর ধরা হয়েছে ৪৭০ টাকা থেকে ৫১৪ টাকা। বন বিভাগের সবশেষ রেট শিডিউল অনুযায়ী, এসব চারার উৎপাদন ও রোপণ ব্যয় সর্বোচ্চ ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। এমন তথ্য জানিয়েছেন প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী।

আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছি বনায়ন আপনাদের কাজ নয়। কেন আপনারা এ কাজ করতে চান। এটা বন বিভাগের কাজ। তাদের জবাব ছিল, বাঁধ, নদী তীর ও খালের জায়গা তাদের। বন বিভাগের মতামত নিয়ে তারা বনায়ন করবে। তখন আমরা বলেছি, যদি বন বিভাগকে দিয়ে সবুজময় করা হয়, তাহলে কমিশনের আপত্তি নেই। কিন্তু এ কাজ পাউবো করতে পারে না। এটা তাদের এখতিয়ার নয়। আমরা সেটি জানিয়ে দিয়েছি
পরিকল্পনা কমিশনের পানিসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মতিউর রহমান

জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশন থেকে আমাদের বলা হয়েছে, সবুজময় করতে হবে বন বিভাগকে দিয়ে। প্রকল্পটি সেভাবে তৈরি করতে বলেছে। আমরা বলেছি বন বিভাগের সহযোগিতায় বনায়ন করা হবে।’ চারার দাম এত বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চারার উৎপাদন, রোপণ, পরিচর্যাসহ সব মিলিয়ে এ টাকা ধরা হয়েছে। সে জন্য বন বিভাগের সঙ্গে পাউবোর দামের এত পার্থক্য।

এদিকে কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বনায়নের প্রকল্পটি নেওয়ার আগে কোনো ধরনের সমীক্ষা করা হয়নি। অথচ ১০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে অবশ্যই প্রকল্পের সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। এটি প্রধানমন্ত্রীরও নির্দেশনা। কিন্তু এ প্রকল্প নেওয়ার আগে সমীক্ষা করা হয়নি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন বিভাগের কাউকে দিয়ে একটি সমীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।

কমিশন বলছে, এ প্রকল্পে গাছ লাগানো নিয়েও আছে অস্পষ্টতা। প্রকল্পে কোন কোন এলাকায় গাছ লাগানো হবে, তা উল্লেখ করা হলেও কোন বাঁধে কত দূরত্বে গাছ লাগানো হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি।

প্রকল্পের নথিতে বলা হয়েছে, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাচিত ঠিকাদারের কাছ থেকে তিন বছরে ৫৬ লাখ চারা সরবরাহ করবে। চারা উৎপাদন, পরিবহন, রোপণের কাজ করবে নির্বাচিত ঠিকাদার। চারা লাগানোর পর থেকে পরবর্তী তিন বছর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারা রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এ সময়ে চারা নষ্ট হয়ে গেলে কিংবা মারা গেলে সমবয়সী চারা রোপণ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অথচ বন বিভাগের সারা দেশে নিজস্ব নার্সারি রয়েছে। অবশ্য পাউবোর এ প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তিতে আটকে আছে।

জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, বনায়নের কাজ বন বিভাগের। অ্যালোকেশন অব বিজনেসে তা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পটি নেওয়ার আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কী কী প্রজাতির গাছ লাগানো যায়, সে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। বন বিভাগের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে একই সময়ে এ কাজের এখতিয়ার যে বন বিভাগের, সেটিও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের কোন অঞ্চলে কোন ধরনের গাছ লাগানো দরকার, তার অভিজ্ঞতা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেই বলেও জানান প্রধান বন সংরক্ষক।