ঢাকা শহরের একেবারে পূর্ব প্রান্ত দিয়ে উত্তর দিকে বয়ে গেছে মান্ডা খাল। খালের ওপারেই মান্ডা হায়দার আলী হাইস্কুল। এ স্কুলে প্রায় ১০০ ভ্যাম্পায়ারের স্থায়ী বসবাস রয়েছে। এদের সঙ্গে আমার বহু বছর ধরে পরিচয়। ১৯৭৪-২০০১ পর্যন্ত টানা ২৭ বছর এদের সঙ্গে ছিল আমার নিত্য বসবাস। ওই ২৭ বছর আমার কর্মস্থল ছিল ঢাকার ৫৪ পুরানা পল্টনে। বায়তুল মোকাররমের উল্টো পাশে, হাউস বিল্ডিং ভবনের মুখোমুখি। হলুদ চারতলা ভবনটি ছিল ১৯৫৪ সালে নির্মিত, নাম ছিল বায়তুল খয়ের। দেয়াল পুরু ছিল ২০ ইঞ্চি করে, প্রতিটি ফ্লোরে ছিল বড় বড় ফোকরের অনেকগুলো করে ভেন্টিলেটর। প্রতিটিতেই ছিল এক জোড়া করে ভ্যাম্পায়ারের স্থায়ী বসবাস। ওই ভবনটি ভেঙে ফেলার পরে ভবনের শত শত ভ্যাম্পায়ার উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিল। সে সময়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘উদ্বাস্তু আবাবিল’ নামে আমার একটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল।
আসলে এরা নিরীহ ও সুমিষ্ট গলার গায়ক পাখি আবাবিল। দেশের বহু অঞ্চলে এরা পরিচিত ‘চাতক পাখি’ নামে। আমার বিবেচনায় দিনের ১২ ঘণ্টার মধ্যে ১১ ঘণ্টাই এরা ওড়ে। গাছের ডালে অন্য পাখিদের মতো বসতে পারে না, পা ছোট, নখর বড়শির মতো, তবে নখরের আঁকশিতে ভর করে ঝুলে বসতে পারে। আকাশে ওড়াই এদের জীবন। ঝাঁক বেঁধে ওড়ে, খেলুড়ে ও ফুর্তিবাজ পাখি এরা। এদের শরীরকাঠামো, ওড়ার গতি ও ছন্দ, ওপর-নিচ করার দক্ষতা ও আচমকা দিকবদলেরÿ ক্ষমতা ফাইটার বা বোমারু বিমানের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এদের দেহকাঠামো তথা ডানা-লেজের গড়ন-ধরনের সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে বিশ্বের দু-তিন রকমের অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমানের।
মাটি থেকে পাঁচ-সাত শ ফুট বা তারও ওপরে এরা ছোটবড় ঝাঁকে উড়ে উড়ে ঘোরে। উড়ে উড়েই এরা ছোট ছোট পোকা খায়, উড়তে উড়তেই বৃষ্টির জল পান করে, বৃষ্টিস্নান করে। মেঘ দেখলেই এদের ফুর্তি বেড়ে যায় বহুগুণে। হয় ওড়ো, না হয় বাসায় ঢোকো—এই হলো আবাবিলের জীবন। রাজধানীতে যেসব অত্যাধুনিক সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলো দেশলাই আকৃতির, এতে না থাকছে ভেন্টিলেটর, না কোনো ফোকর। কোটরবাসী নাগরিক পাখিদের তাই খুব সমস্যা।
আবাবিলের ইংরেজি নাম House Swift। বৈজ্ঞানিক নাম Apus affinis। মাপ ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ২১ গ্রাম। ব্যাঙের মতো চ্যাপ্টা মাথা, ছোট ঠোঁট (হাঁ করলে ব্যাঙের হাঁ-এর মতো লাগে), ও গোলাপি-বাদামি পায়ের এই পাখি একনজরে কালো। লেজের গোড়া ও গলার নিচটা তুলোট সাদা। চোখ কালো। বাসা করে মুরগির বা অন্য পাখির ফুলপালক দিয়ে। নিজের লালা ও মলও ব্যবহার করে পেস্টের মতো। চমৎকার সাদা রঙের লম্বাটে ধরনের দুটি ডিম পাড়ে। দুজনেই পালা করে তা দেয় ডিমে। বাচ্চা ফোটে ১৫-২০ দিনে।