আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় সরকারের বিবৃতি সময়োপযোগী, তবে যথেষ্ট নয়: টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)ফাইল ছবি

‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা নিয়ে সরকার যে বিবৃতি দিয়েছে, তা সময়োপযোগী হলেও যথেষ্ট নয়। এ কথা বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সরকারের বিবৃতিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় না দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনটি। আজ শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ ক্ষোভ জানায় টিআইবি।

পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতি রাখা ও না–রাখা নিয়ে রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনের সামনে গত বুধবার সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটে। পরে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা অভিযোগ করে, স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামের একটি সংগঠন তাদের ওপর হামলা করেছে।

এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে এ হামলার তদন্তের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়। ইংরেজিতে দেওয়া ওই বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের ‘এথনিক মাইনরিটি’ বা জাতিগত সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়।

আজ টিআইবির বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গতকালের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ অবস্থান স্পষ্টভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশে সহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই। যারা ঐক্য, শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সরকারের এ বার্তাকে সময়োপযোগী হিসেবে স্বাগত জানাই। তবে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে এতে দৃশ্যত সচেতনভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পরিচয় হিসেবে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, যা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত প্রধান উপদেষ্টার ২৫ আগস্টের ২০২৪–এর ভাষণে আদিবাসী পরিচয়বিষয়ক শব্দচয়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি এটি সচেতনভাবেই ঘটে থাকে, তাহলে কি এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী এজেন্ডা ও বয়ানের প্রতিফলন ঘটেছে বলে ধরে নিতে হবে না?’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, আদিবাসী পরিচয়ের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা ও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চর্চার অনুসরণে অবস্থান নির্ধারণের জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আদিবাসী পরিচয় ব্যবহারের বিরোধী অন্য সব অংশীজনের প্রতিও আমাদের একই আহ্বান। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মাধ্যমে সম্ভব নয়, কর্তৃত্ববাদ চেতনা ও এজেন্ডা এবং তার বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চর্চার আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য।’

টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, এনসিটিবির নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দিয়ে নিজেকে পতিত কর্তৃত্ববাদের দোসর ও পুনর্বাসনকেন্দ্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। এনসিটিবির এ সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী সময়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত সংক্ষুব্ধ আদিবাসীদের ওপর ধারাবাহিক হামলাকে রক্তস্নাত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সূচিত বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের চেতনা ও প্রত্যাশার সঙ্গে প্রতারণা। এনসিটিবির জবাবদিহিসহ এই প্রতিষ্ঠানকে কর্তৃত্ববাদের দোসরমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানানো হয় টিআইবির ওই বিবৃতিতে।

আরও পড়ুন

টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে থাকা আদিবাসীসহ সব বৈচিত্র্যের মানুষের সম–অধিকারের প্রতিফলনমূলক গ্রাফিতি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরিয়ে দিয়েছে এনসিটিবি। এনসিটিবির এ পদক্ষেপকে কর্তৃত্ববাদের এজেন্ডা বহাল রাখার ঘৃণ্য প্রয়াস উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এনসিটিবি প্রমাণ করতে চেয়েছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও এই সংস্থায় কর্তৃত্ববাদের চর্চার পরিবর্তন হয়নি; বরং যৌক্তিক প্রশ্ন উঠেছে, এনসিটিবি কি বাস্তবে পতিত কর্তৃত্ববাদের এজেন্ডা বহাল রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে?’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয় ব্যবহার করা যাবে না, এমন উদ্ভট তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিল কর্তৃত্ববাদী সরকার। আর তার পেছনে ইন্ধন ছিল এমন স্বার্থান্বেষী মহলের, যারা আদিবাসী অধিকার হরণের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীকে বলতে চেয়েছিল, “বাংলাদেশে আদিবাসী নেই।” তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বীকার করতে চায়নি যে আদিবাসী পরিচয়ের মানদণ্ড কোনো জনগোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে কতকাল ধরে বসবাস করছে, তার ওপর নির্ভর করে না। তারা মানতে চায়নি যে আদিবাসী হচ্ছে মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে এমন জনগোষ্ঠী, যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথাগত ও প্রাকৃতিক পরিবেশ-নির্ভর জীবনাচরণের ধারা বহাল রেখে নিজেরা আদিবাসী হিসেবে পরিচিত থাকতে চায়।

আরও পড়ুন

বিবৃতিতে বলা হয়, আদিবাসী পরিচয়ের উক্ত ব্যাখ্যা যে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত, তা না জানা এনসিটিবির জন্য লজ্জাজনক। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কোনো প্রকার বিচার–বিবেচনা না করে এক পক্ষের আবদারের দোসর হওয়া পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়। একই সঙ্গে তা নজিরবিহীন রক্তপাত ও প্রাণহানির বিনিময়ে অর্জিত অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈষম্যমুক্ত “নতুন বাংলাদেশ”-এর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, প্রতারণাও বটে।

গত বুধবার সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যানারে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। তারা বিক্ষোভকারীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, তাঁদের অন্তত পাঁচজন গতকালের ঘটনায় আহত হন।