মালিকদের ‘চাপে’ পিছু হটল সরকার, পুরোনো বাস চলবে
বাস ও মিনিবাসের ৪০ শতাংশের বয়স ২০ বছরের বেশি।
ভাড়া নির্ধারণের সময় বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ১০ বছর।
বায়ুদূষণের বড় কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া।
পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের চাপের মুখে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে সরকার। ফলে ২০ বছরের পুরোনো বাস এবং ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক অবাধে চলতে পারবে সড়কে।
সড়ক দুর্ঘটনা ও পরিবেশদূষণের বড় কারণ পুরোনো যানবাহন—এই বিবেচনায় ২০ বছরের পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত ১৭ মে প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
পাশাপাশি একটি নীতিমালা করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে যানবাহনগুলো কী প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করা হবে (স্ক্র্যাপ), তা ঠিক করার কথা ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পরিচালনায় যুক্ত একাধিক মালিক সমিতি পুরোনো যানবাহন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
সংগঠনগুলো পুরোনো যানবাহন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয় আগের প্রজ্ঞাপন স্থগিত করে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় পুরোনো যানবাহনের বয়সসীমা নির্ধারণের আগে তাদের সঙ্গে কথা বলেনি। একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক যানবাহন তুলে দিলে শূন্যতা তৈরি হবে। এর প্রভাব যাত্রী পরিবহন ও বাণিজ্যে পড়বে। এ জন্য তাঁরা সরকারকে চিঠি দিয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত করার আবেদন করেছিলেন। তিনি বলেন, এখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করা হবে।
৪১% বাসই পুরোনো
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, বাস ও ট্রাকের চলাচলের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার পর সংস্থাটি একটি তালিকা করেছে। এতে দেখা গেছে, ২০ বছরের সীমা নির্ধারণ করা হলে ৩৩ হাজার ১৭৪টি বাস-মিনিবাস রাস্তা থেকে উঠে যাবে। আর ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাকের সংখ্যা ৩০ হাজার ৬২৩টি।
বিআরটিএর তথ্যমতে, সারা দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৮১ হাজার ৮৪৭। হিসাব করে দেখা যায়, বাস-মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। অন্যদিকে দেশে নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরির সংখ্যা ২ লাখ ২ হাজার ৭৭২। এর মধ্যে ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক ১৫ শতাংশের মতো।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের মতো সংগঠিত শক্তিকে রুষ্ট করতে চায়নি সরকার। এ কারণে তাদের দাবি মেনে পুরোনো যানবাহন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে।
সিদ্ধান্তগুলো যাঁরা নেন, তাঁরা নিজেরাও বায়ুদূষণের ভুক্তভোগী, তাঁদের বয়স্ক মা-বাবা ভুক্তভোগী, তাঁদের শিশুসন্তানেরা ভুক্তভোগী।
এর আগে নছিমন, করিমন, ভটভটির মতো যানবাহন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে চলতে না দেওয়ার বিষয়ে একাধিকবার জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এসব যানবাহন চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার উদ্যোগের বিরোধিতা করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। গত ৩০ জুলাই কমিটির বৈঠকে বলা হয়, ধীরগতির যানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে আগামী নির্বাচনে প্রভাব পড়বে।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, ২০ বছরের পুরোনো কিছু বাস এমনিতেই অচল হয়ে গেছে। সংখ্যা কত, সে হিসাব বিআরটিএতে নেই। কিছু বাস চলাচল করছে নিবন্ধন না নিয়েই। একই ঘটনা ঘটছে পণ্যবাহী যানবাহনের ক্ষেত্রে। সরকার পুরোনো যানবাহন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিআরটিএ এসব যানের ফিটনেস সনদ দেওয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রাখে। এখন আবার সনদ দেওয়ার কার্যক্রম চালু হবে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, বাসের ভাড়া নির্ধারণ করার সময় ধরে নেওয়া হয় একটি বাস সর্বোচ্চ ১০ বছর চলাচল করবে। এ সময়সীমার মধ্যেই ব্যাংকঋণ পরিশোধ করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ১০ বছর পর বাস আর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না ধরে নিয়েই যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরিবহনমালিকেরা নির্ধারিত সময়ের দ্বিগুণের বেশি বাস চালান, আয় করেন।
‘মানুষের কথা ভাবা হয় না’
রাজধানীতে চলাচলকারী পুরোনো বাস কালো ধোঁয়া ছড়ায়। বায়ুদূষণে ঢাকা প্রায়ই বিশ্বে ১ নম্বর অবস্থানে থাকে। পাশাপাশি বাসের আসন ছেঁড়া ও ময়লা থাকে। এর মধ্যেই গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলা ও ধোঁয়ার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ ও পুরোনো যানবাহনের দূষিত বায়ু।
বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে পুরোনো যানবাহনের দায় অনেক বেশি। সেগুলো উঠিয়ে দিতে হবেই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের কথা ভাবা হয় না। তিনি বলেন, সিদ্ধান্তগুলো যাঁরা নেন, তাঁরা নিজেরাও বায়ুদূষণের ভুক্তভোগী, তাঁদের বয়স্ক মা-বাবা ভুক্তভোগী, তাঁদের শিশুসন্তানেরা ভুক্তভোগী।