‘এটা আপনার জন্য না’
৩ আগস্ট, ভোর পাঁচটা! তাপমাত্রা ৯ বা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফেরি থেকে ঝাঁপ দিতে হলো হিমশীতল পানিতে। এক কিলোমিটার সাঁতরানোর পর ডান পায়ের মাংসপেশি অসাড় (ক্র্যাম্প) হয়ে আসে। ডান পা আর কাজ করছে না। খানিক পর বাঁ পায়েরও একই দশা হলো; কিন্তু থামলেন না। দুই হাত চালিয়েই শেষ করলেন ৩.৮ কিলোমিটার সাঁতার। খানিক বিরতি আর পা দুটি ম্যাসাজ করে এবার সাইকেলের পিঠে চড়ে বসলেন। পাহাড়ি চড়াই–উতরাই মাড়িয়ে ১৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেন। তারপর আবার ৪২.২ কিলোমিটার দৌড়।
সাঁতার, সাইকেল আর দৌড়—সব মিলিয়ে ২২৬ কিলোমিটারের অনবদ্য সফরনামা শেষ করতে হয়েছিল তাঁকে। পুরো রেসটাই করেছিলেন নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়েতে। তিনি ইমতিয়াজ এলাহী। আয়রনম্যান হিসেবে লোকে তাঁকে চেনে। সেনাবাহিনীতে প্যারাশুট ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে নামার সময় এক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ড ভেঙেছিল তাঁর। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। সেই অবস্থা থেকে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ইমতিয়াজ। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় আয়রনম্যানের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়েছেন। সম্প্রতি নরওয়েতে করে এসেছেন ‘নরসম্যান এক্সট্রিম ট্রায়াথলন’। একে বলা হয় পৃথিবী নামক গ্রহটির কঠিনতম প্রতিযোগিতার একটি।
আয়রনম্যান কী: আয়রনম্যান দীর্ঘ দূরত্বের ট্রায়াথলন। যেখানে ৩.৮ কিলোমিটার সাঁতার, ১৮০ কিলোমিটার সাইকেল চালনা ও ৪২.২ কিলোমিটারসহ মোট ২২৬ কিলোমিটারের একটা প্রতিযোগিতা, যেটা ১৭ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হয়। আর এক্সট্রিম ট্রায়াথলনে দূরত্ব একই থাকে; কিন্তু কর্মকাণ্ডগুলো প্রতিযোগীদের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর করে তোলা হয়। যেমন ৩.৮ কিমি সাঁতার ট্রায়াথলন, এক্সট্রিম ট্রায়াথলন দুই জায়গাতেই আছে; কিন্তু এক্স–ট্রাইওতে হয়তো হিমশীতল পানিতে সাঁতরাতে হচ্ছে প্রতিযোগীকে। দৌড়াতে হয় পাহাড়ি চড়াই–উতরাইয়ের মাঝে।
‘নরসম্যান এক্স–ট্রাই’–তে অংশ নিতে অনেকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে থাকে, প্রস্তুতি নেয়। আমার জানামতে, বাংলাদেশ থেকে এর আগে কেউ এ চ্যালেঞ্জে অংশ নেননি’—বললেন ইমতিয়াজ।
নরসম্যানের ওয়েবসাইটকে উদ্ধৃত করে ইমতিয়াজ বলেন, ‘ওরা ওদের সাইটে শুরুতেই একটা কথা লিখে রেখেছে, “দিস ইজ নট ফর ইউ”। অর্থাৎ এটা আপনার জন্য না।’ এটা এমনই কঠিন এক প্রতিযোগিতা যেখানে কোনো রকম সহায়তা পাওয়া যায় না। যা করার একা একাই করতে হয়। কেবল সাপোর্ট ক্রু হিসেবে প্রতিযোগীরা দুজন করে নিজস্ব লোক রাখতে পারেন, যাঁরা শুধু রেস চলাকালে পানি আর খাবার দিয়ে প্রতিযোগীকে সহায়তা করতে পারবেন; কিন্তু আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য–সহযোগিতা করা হয় না।
নরসম্যান এক্সট্রিম ট্ট্রায়াথলনে যোগ দিতে গত ২৮ জুলাই নরওয়েতে পৌঁছান ইমতিয়াজ। আরও ২৫০ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে ৩ আগস্ট ভোর পাঁচটায় সাঁতার কাটতে নামেন। ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের মধ্যে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতরানোর কথা। সেখানে ১ ঘণ্টা ৪৬ মিনিটে সাঁতার শেষ করেন ইমতিয়াজ।
তারপর ১৮০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হবে আর উঠতে হবে মোট ৩৫০০ মিটার উচ্চতা, তা–ও পাহাড়ি রাস্তায়। তারপর পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ কয়েকটা দুই–তিন কিলোমিটার লম্বা টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। খানিক পরপর এমন লম্বা টানেল আর খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হচ্ছিল। তবে মাঝখানে অল্প কিছুদূর সমতলও ছিল। সঙ্গে ছিল হেড উইন্ড বা সামনে থেকে ধেয়ে আসা বাতাস। এমনিতেই ঠান্ডা, তার ওপর বাতাসের কারণে শরীর অসাড় হয়ে আসতে চায়—বলছিলেন ইমতিয়াজ। শেষের ক্লাইম্বটা ছিল কঠিন। তারপর ছিল ২৫ কিলোমিটার ডাউনহিল। সাইক্লিং করার সময় প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছিলেন ১৮ জন প্রতিযোগী। কারণ আর কিছু না; সময়মতো ১৮০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে না পারা।
নিয়ম মেনে প্রতিযোগিতা শুরুর পর থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে সাইক্লিংয়ের পাট চুকিয়ে ফেলতে হয়। এই ১২ ঘণ্টার মধ্যে সাঁতারের অংশটুকুও আছে। অর্থাৎ সাঁতারের সময় বাদ দিলে সাইকেল চালানোর জন্য সময় থাকে ৯ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। এর মধ্যেই সাইকেল চালানোর ইতি টানতে হয়। সময় ফুরানোর মাত্র আড়াই মিনিট আগে সাইকেল চালানো শেষ হয় ইমতিয়াজের। ‘আমার ইনজুরি বেশি, তাই সবকিছুতে সময়টা বেশি লাগে’, বলছিলেন ইমতিয়াজ।
সাইক্লিং শেষে শুরু হয় ৪২.২ কিমি দৌড়। প্রথম ২১ কিলোমিটার দৌড়ানোর পর খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয়। তখন দৌড়ানো, হাঁটা, পাহাড় বাওয়া সব মিলেমিশে একাকার। সময় ফুরানোর ৭ মিনিট আগে দৌড় শেষ হয়। দৌড় শেষ করতে রাত ১২টা বেজে যায়। সেদিন নরওয়েতে সূর্যাস্ত ছিল সাড়ে ৯টায়। তারপরই তাপমাত্রার পারদ নিচে নামতে থাকে।
এমন একটা এপিক চ্যালেঞ্জ কী করে শেষ করলেন জানতে চাইলে খানিক হাসলেন আয়রনম্যান। তারপর বললেন, কঠোর অনুশীলন, লম্বা একটা সময় ধরে প্রস্তুতি আর প্রচণ্ড মানসিক মনোবল। এগুলো না থাকলে সফল হওয়া সম্ভব না। কারণ একটা সময় শরীর আপনাকে আর সাপোর্ট দেবে না তখন মানসিক শক্তিটা সবচেয়ে জরুরি। সেটাই আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে।
এক্সট্রিম ট্রায়াথলনের জন্য ইমতিয়াজ প্রস্তুতিটা শুরু করেছিলেন কয়েক মাস আগে থেকে। শুরুতে সপ্তাহে আট ঘণ্টা অনুশীলন করতেন। শেষের দিকে এসে সেটা ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টায় দাঁড়ায়। সার্বিয়ান এক কোচের কাছে অনলাইনে পাঁচ মাস অনুশীলন করেছেন। তবে প্রতিযোগিতায় সাপোর্ট ক্রু খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুরো প্রতিযোগিতায় ১৯–২০ ঘণ্টা ধরে ট্রায়াথলেটকে সাহায্য করতে হয় তাঁদের। ইমতিয়াজকে সাহায্য করেছেন যে দুজন, তাঁরাও ট্রায়াথলেট। মাহবুবুর রহমান ও আসাদুজ্জামান থাকেন জার্মানিতে। এই দুজন ছাড়া কিছুতেই কঠিন এই কাজটা শেষ করতে পারতেন না, জানান ইমতিয়াজ।
এমন প্রতিযোগিতায় খরচাপাতি কেমন হয়—জানতে চাইলে ইমতিয়াজ বললেন, আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা থেকেও বেশি লাগে। অনেক দূরের দেশ, যেহেতু ঠান্ডা বেশি, তাই প্রতিটা পর্বেই কয়েক প্রস্ত কাপড়চোপড়, গ্যাজেট–গিয়ার এসব প্রচুর কিনতে হয়েছে। দুজন সাপোর্ট ক্রুকে জার্মানি থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। নিজের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া এসব তো আছেই।
একনজরে ইমতিয়াজ এলাহী
২০১৭: ঢাকা চ্যালেঞ্জ ট্রায়াথলনে অংশগ্রহণ করেন
২০১৮ (জুন): ব্যাংকক ট্রায়াথলনে যোগ দেন
২০১৮ (নভেম্বর): মালয়েশিয়ার লংকাউইতে প্রথম আয়রনম্যানে যোগ দেন। সেবার ১৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিটে রেস করেন।
২০১৯: ইন্দোনেশিয়ায় অর্ধদূরত্বের আয়রনম্যানে অংশ নেন। যেখানে ১.৮ কিলোমিটার সাঁতার, ৯০ কিমি সাইকেল চালনা ও ২১.১ কিমি দৌড়াতে হয়।
২০২০: করোনার কারণে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেননি।
২০২১ (ডিসেম্বর): ১৬.১ কিমি দূরত্বের বাংলা চ্যানেলে সাঁতারে অংশ নেন
২০২২: মালয়েশিয়ায় আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সেবার তাঁর টাইমিং ছিল ১৪ ঘণ্টা ২৩ মিনিট।
২০২৩ (মে মাস): হিমালয়ান এক্সট্রিম ট্রায়াথলনে যোগ দেন।
২০২৩ (অক্টোবর): মালয়েশিয়ার লঙ্কাউইতে তৃতীয়বারের মতো আয়রম্যান প্রতিযোগিতায় যোগ দেন।
আয়রনম্যান হিসেবে নিজেকে ফিট রাখতে রোজ কিছু না কিছু করেন ইমতিয়াজ। হয় দৌড়ান, নয়তো সাইকেল চালান কিংবা সাঁতার কাটেন। তিনি একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত। আর ব্যক্তিজীবনে এক ছেলের বাবা। স্ত্রী সিউতী সবুর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। স্ত্রী–ছেলেও শরীরচর্চা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন। পরিবারের সহায়তা না পেলে আয়রনম্যানের মতো দিনের পর দিন কঠিন অনুশীলনে একনিষ্ঠভাবে লেগে থাকতে পারতেন না, জানালেন ইমতিয়াজ।
কখনো কি মনে হয়নি এত কঠোর অনুশীলন, পরিশ্রম—এসব না করলেও হতো? এমন প্রশ্নের জবাবে হাসলেন আয়রনম্যান। তিনি বলেন, ‘আমি করেছি মানুষকে উৎসাহিত করতে। তরুণ প্রজন্ম যেন রোমাঞ্চের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।’