বাংলাদেশে হেনরি কিসিঞ্জারের প্রথম সফর কেমন ছিল

নিউইয়র্কে বঙ্গবন্ধু-কিসিঞ্জার সাক্ষাৎ। ছবি: সংগৃহীত

সব মিলিয়ে হেনরি কিসিঞ্জারের কূটনীতিক জীবন ছিল ৫০ বছরের। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী ছিলেন। একই সঙ্গে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৪০ মাস তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। অর্থাৎ রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ড দুজনই আস্থা রেখেছিলেন কিসিঞ্জারের ওপর। এরপর ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিলেন বৈদেশিক গোয়েন্দা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য। আবার ২০০১ থেকে ২০২০, এই দুই দশক প্রতিরক্ষা নীতিবিষয়ক বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সুতরাং সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ বছরের কূটনীতিক জীবন ছিল কিসিঞ্জারের। তাঁর বাকি পরিচয় হচ্ছে একজন বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও অধ্যাপক।

তবে কিসিঞ্জার বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান পাবেন স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী হিসেবে। স্বাধীন হওয়ার পরেও যে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি বা ‘বাস্কেট কেস’-এর পেছনেও অবদান কিসিঞ্জারের।

যেভাবে বাস্কেট কেস কথাটা এসেছিল

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা। আলোচনা হচ্ছিল বাংলাদেশ নিয়েই। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ডেভিড প্যাকার্ড, চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টমোরল্যান্ড, সিআইএর পরিচালক রিচার্ড হেলমস, আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ও জাপানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউ এলেক্সিস জনসন, ইউএসএআইডির উপপ্রশাসক মরিস উইলিয়ামস এবং ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন।

সভায় আলোচনা হচ্ছিল মূলত পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে। বিশেষ করে মার্চে যে বাংলাদেশে বড় ধরনের খাদ্যসংকট হবে, দুর্ভিক্ষও হবে, এ বিষয়গুলো নিয়ে। একপর্যায়ে বৈঠকের কথোপকথন ছিল এ রকম—

কিসিঞ্জার: পূর্ব পাকিস্তানে কি দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা আছে?

মরিস উইলিয়ামস: সেখানে কিছুদিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহের মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে, তাদের প্রচুর ফসল আছে।

কিসিঞ্জার: তাহলে কি আগামী বসন্তের পরে?

উইলিয়ামস: হ্যাঁ, যদি না তারা মার্চের মধ্যে নিজেদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না নিতে পারে।

কিসিঞ্জার: আমাদের তখন খাদ্যসহায়তা পাঠাতে হতে পারে?

উইলিয়ামস: হ্যাঁ।

কিসিঞ্জার: তাহলে এ ব্যাপারে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত।

উইলিয়ামস: মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের আরও অনেক ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।

জনসন: সেটা হবে একটা ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস।

কিসিঞ্জার: হ্যাঁ, তবে শুধু আমাদের বাস্কেট কেস না।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার
ছবি: রয়টার্স

বলা যায়, সেই থেকে বাস্কেট কেস বা তলাবিহীন ঝুড়ি কথাটা বাংলাদেশের হয়ে যায়। অর্থাৎ দেশটিতে যে সাহায্য দেওয়া হোক, তা ঝুড়ির ফুটো দিয়ে পড়ে যাবে। এরপর থেকে দীর্ঘ বছর পর্যন্ত প্রসঙ্গ এলেই বাংলাদেশকে বলা হতো বাস্কেট কেস। যেমন বাংলাদেশের খাদ্যসংকট ও খাদ্য-সাহায্য নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর যে সম্পাদকীয় লিখেছিল, তার শিরোনাম ছিল ‘বাস্কেট’। আবার বাকশাল কায়েমের পর ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস–এর সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল, ‘ওয়ান ম্যানস বাস্কেট কেস’

তবে বাংলাদেশকে এখন আর কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলে না। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এ বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টটির শিরোনাম দিয়েছিল, ‘বাংলাদেশ, “বাস্কেট কেস” নো মোর’

কিসিঞ্জারের প্রথম বাংলাদেশ সফর

সেই হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশে এসেছিলেন স্বাধীনতার তিন বছরের মধ্যেই, ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর। সফরটি ছিল ১৯ ঘণ্টার। পুরো উপমহাদেশ সফরে বের হয়েছিলেন তিনি। দিল্লি থেকে ঢাকায়, তারপর যান ইসলামাবাদে। কঠিন এক সময় পার করছে তখন বাংলাদেশ। ভয়াবহ বন্যা আর ব্যাপক খাদ্যসংকটের পরে বাংলাদেশ তখন দুর্ভিক্ষাবস্থায়। বৈদেশিক সহায়তা তখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু। সে রকম এক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জার বিপুল সংবর্ধনা পেয়েছিলেন বাংলাদেশে।

দৈনিক ইত্তেফাকের ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদ
ছবি: সৌজন্যে সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক হেনরি কিসিঞ্জারের একটি বড় ছবিসহ মূল শিরোনাম করেছিল, ‘কিসিঞ্জারের আজ ঢাকা আগমন’। সেখানে লেখা হয়েছিল,

‘ড. কিসিঞ্জার এমন এক সময় বাংলাদেশ সফরে আসিতেছেন যখন এই নব্য স্বাধীন দেশ কঠিন দুর্ভিক্ষ ও অগণিত সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত। তিনি স্বচক্ষে দেখিবেন এই জাতি সাহসিকতার সহিত এই সংকটের মোকাবিলা করিতে সচেষ্ট।’

একই দিন ‘হেনরি কিসিঞ্জারের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য’ শিরোনামে মোটামুটি দীর্ঘ একটি লেখাও ছেপেছিল ইত্তেফাক।

স্ত্রী ন্যান্সি কিসিঞ্জারসহ মোট ৭৭ সদস্য নিয়ে কিসিঞ্জার ঢাকায় এসেছিলেন ৩০ অক্টোবর বেলা দেড়টায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন সস্ত্রীক বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা দেন তাঁদের। কিসিঞ্জার ঢাকায় ওই দিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ৭৫ মিনিট বৈঠক করেছিলেন তিনি। আর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছিলেন। রাতে ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ভোজসভা। দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল, এক লাখ টন খাদ্য–সাহায্যের। আর এটাই ছিল পরদিনের প্রতিটি পত্রিকার মূল শিরোনাম।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের পরে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি না হলে বাংলাদেশ টিকে থাকত না। আমি প্রধানমন্ত্রীর অনেক প্রশংসা করি। তিনি স্বীয় বিশ্বাসের বলে একটি জাতির স্রষ্টা। তিনি তাঁর দেশের জনক। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের সাহচর্যের সুযোগ সব সময় হয় না।’

হেনরি কিসিঞ্জারের জন্য ছিল কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। একটি কালো রঙের বুলেটপ্রুফ লিমুজিন আনা হয়েছিল দিল্লি থেকে। ন্যান্সি কিসিঞ্জারকে সংবর্ধনা দিয়েছিল বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা ফেডারেশন নামের একটি সংগঠন। সেই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ আর নেচেছিলেন অঞ্জনা রহমান।

দৈনিক ইত্তেফাকের ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদ
ছবি: সৌজন্যে সংগ্রামের নোটবুক

হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর আরও দুবার দেখা হয়েছিল ঠিক এক মাস আগে। জাতিসংঘের সাধারণ সভায় যোগ দিতে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন। নিউইয়র্কের হোটেলে কিসিঞ্জার দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। আর ১ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে। সে সময়ও কিসিঞ্জার উপস্থিত ছিলেন। এর এক মাসের মধ্যেই ঢাকায় আসেন কিসিঞ্জার।

এটাও বলা প্রয়োজন, কিসিঞ্জারের সফরের কয়েক দিন আগে, ২৬ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেছিলেন, যিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বলেছিলেন, বাংলাদেশ কখনো মার্কিন সাহায্য নেবে না।

হেনরি কিসিঞ্জারের সেই সফরের পরে অবশ্য অনেক কথা হয়েছিল। যেমন ২০২১ সালের ১১ আগস্ট সরকারি বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বে কিসিঞ্জারের সফর ছিল নানাদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ’ শিরোনামে একটি বিশেষ লেখা প্রচার করেছিল। সেখানে লেখা হয়েছিল,

গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা শেষে কিসিঞ্জার অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন,

“একটি মানুষের অনুধাবন ক্ষমতা যে এত ব্যাপক হতে পারে তা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ না হলে তিনি কখনো বুঝতে পারতেন না। জাতির পিতার কাছ থেকে এই অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।” এ সময় একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, শেখ মুজিবের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা যদি এমনই তাহলে আপনি ১৯৭১ সালে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন কেন? কিসিঞ্জার এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সম্মেলনকক্ষ ত্যাগ করলে তিন মিনিটের মধ্যেই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হয়ে যায়।’

যদিও ৩১ অক্টোবরের কোনো সংবাদপত্রেই সংবাদ সম্মেলন সংক্ষিপ্ত হওয়ার এই তথ্য পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

হঠাৎ দেখা হেনরি কিসিঞ্জার

সেই হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে বাংলাদেশের একদল সাংবাদিকের দেখা হয়েছিল ২০০৮ সালে, সুইজারল্যান্ডের দাভোস শহরে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে। সেই সাংবাদিক দলে এই প্রতিবেদক ছিলেন। সেদিন ছিল সম্মেলনের প্রথম দিন। সম্মেলন কেন্দ্রে ঢুকতেই দেখা হয়েছিল সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারের সঙ্গে। ঠিক তখনই দেখা গেল, লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হেনরি কিসিঞ্জার। সেই সফরের সঙ্গী ছিলেন বার্তা সংস্থা ইউএনবির শামীম আহমেদ। সুযোগটি ছাড়লেন না তিনি। কাছে গিয়ে হেনরি কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করলেন,

‘বাংলাদেশকে মনে আছে আপনার? সেই যে আপনি বাস্কেট কেস বলেছিলেন। এখন কী বলবেন?’

প্রশ্নটি শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে কিসিঞ্জার উত্তর দিয়েছিলেন,

‘বিশেষ এক সময়ের পরিস্থিতিতে এ কথা বলেছিলাম। এখন আর সে বিষয়ে কোনো কিছু বলতে চাই না।’

কথা আর সেদিন এগোয়নি।

হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেলেন আজ। গত মে মাসে তাঁর ১০০ বছর বয়স হয়। ১৯২৩ সালের ২৭ মে জার্মানীর ব্যাভেরীয় এলাকা ফার্থ–এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন