আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কার হলে তা টেকসই হয়

‘ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করতে সংবিধানের কী কী সংস্কার দরকার?’ শীর্ষক মেরামত আলাপের আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্ম।ছবি: প্রথম আলো

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে সংবিধানকে জনমুখী করে তোলার আকাঙ্ক্ষা খুব পরিষ্কার। সংশোধন হোক বা নতুন সংবিধান হোক, এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া টেকসই হবে কি না—তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা এবং রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কারণে আসন শূন্য হওয়াসংক্রান্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন দরকার।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে শনিবার সন্ধ্যায় এক সংলাপে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। ‘ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করতে সংবিধানের কী কী সংস্কার দরকার?’ শীর্ষক এই মেরামত আলাপের আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্ম।

আলোচনায় অংশ নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, ‘মাসদার হোসেন (নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণ–সংক্রান্ত) মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। ১২টি নির্দেশনা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। এটি কার্যকরভাবে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে অনেকটা এগিয়ে যাব। মূল সমস্যা ১১৬ অনুচ্ছেদ। অধস্তন আদালত সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে থাকবে, এটি বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল। এটি পুনর্বহাল করতে হবে। এই অনুচ্ছেদকে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে।’

সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিল, সেটি যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাতিল হলো, তা দুর্ভাগ্যজনক। হয় রিভিউ (পুনর্বিবেচনার আবেদন) করে এটি শেষ করতে হবে। অথবা অ্যাক্ট অব পার্লামেন্টের মাধ্যমে প্রত্যাহার করতে হবে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা–সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মৌলিক অধিকার দেওয়া হচ্ছে, তবে সীমা টেনে দিচ্ছে। মৌলিক অধিকার শর্তহীন হতে হবে।

এখনকার সময় প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের গ্লোবাল একাডেমি ফেলো সিনথিয়া ফরিদ। ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করা যেতে পারে, জনসাধারণকে আরও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সংশোধন হোক বা নতুন সংবিধান হোক—এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছাড়া টেকসই হবে কি না, সেটি বিবেচনা করে দেখতে হবে। সংস্কারপ্রক্রিয়া যখন আলোচনার ভিত্তিতে হয় না, তখন কিন্তু সংস্কার টেকসই হয় না।

’৭২ সালে ভালো সংবিধান লেখা হয়নি বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা লাগবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে। সাংবিধানিক পদে ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় নিয়োগে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করার ওপর গুরুত্ব তিনি।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন ভয়েস ফর রিফর্মের সহ–আহ্বায়ক সৈয়দ হাসিব উদ্দিন হোসেন। তিনি বলেন, অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে সংবিধানকে জনমুখী করে তোলার আকাঙ্ক্ষা খুব পরিষ্কার।

ভয়েস ফর রিফর্মের পক্ষে সাত দফা প্রত্যাশা তুলে ধরেন সৈয়দ হাসিব উদ্দিন হোসেন। এতে বলা হয়, ‘আর কোনো দিন যেন কোনো স্বৈরাচার আমাদের রাষ্ট্র দখল করে নিতে না পারে; সংবিধানে যে সংস্কার করা হবে, সেটি যাতে পরবর্তী সময়ে অবৈধ ঘোষণা করা না যায়; নাগরিকের সাপেক্ষে রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমা বেঁধে দেওয়া; নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যাতে দলের পরিবর্তে তাঁর এলাকার মানুষসহ সারা দেশের সকল মানুষের স্বার্থ রক্ষা করেন; দেশের মানুষের টাকায় গড়া বাজেট যাতে অপচয় না হয়, দেশের মানুষের সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার জন্যই ব্যবহৃত হয়; সংবিধান সংস্কারের ভাবনা যেন দেশের সকল স্তরের এবং সকল স্থানের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে তৈরি করা হয়; সরকারের কর্মচারীদের কাজের মান নিয়েও জবাবদিহির ব্যবস্থাও থাকতে হবে।’

অনুষ্ঠানের শুরুতে গত ১৯ জুলাই শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ বলেন, ‘গত ২৫ আগস্ট মামলা করেছি, মামলার সে রকম কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিচারটা আসলে অনেক দ্রুত হওয়ার কথা ছিল। এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা চাচ্ছি।’ তিনি বলেন, রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন, যারা মারা গেল, তারা কি শহীদ, নাকি নিহত?