স্ট্রোকের রোগীর জন্য ‘সময়ই জীবন’
স্ট্রোকের (মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ) রোগী যত দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আসে, ততই তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলেই রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। স্ট্রোকের রোগীর জন্য সময় মানেই জীবন। স্ট্রোকে আক্রান্ত কি না, বুঝতেই বেশি সময় যায়। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা জরুরি, পাশাপাশি দক্ষ জনবল ও হাসপাতালের প্রস্তুতিও গুরুত্বপূর্ণ।
রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত নিয়মিত মাসিক কেন্দ্রীয় সেমিনারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এ কথা বলেন। কেন্দ্রীয় সেমিনারে এবারের বিষয় ছিল স্ট্রোকের চিকিৎসা। সেমিনারে স্ট্রোকের কারণ ও চিকিৎসা নিয়ে তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়া বা মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়াই স্ট্রোক।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ স্ট্রোক। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিবন্ধিতারও কারণ এ স্ট্রোক। স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার অন্যতম প্রধান কারণ স্ট্রোক।
প্রথম উপস্থাপনায় বিএসএমএমইউর নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির ১৯ লাখ করে মস্তিষ্কের কোষ (নিউরন) প্রতি মিনিটে মরে যেতে থাকে। যত মস্তিষ্কের কোষ মারা যায়, তত মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে থাকে। যত সময় যায়, তত ক্ষতি বাড়ে। তাই বলা হয় ‘টাইম ইজ ব্রেইন’ (সময়ই মস্তিষ্ক)। এই ক্ষতি হওয়া বন্ধে দ্রুত চিকিৎসা দরকার। সে কারণে স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে, রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রশ্ন–উত্তর পর্বে বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ ঠিক সময়ে হাসপাতালে আসে না বা মানুষ জানে না কোন হাসপাতালে যেতে হবে। স্ট্রোকে আক্রান্ত কি না, এটা বুঝতেও অনেকের সময় লেগে যায়। আবার হাসপাতাল তৈরি থাকে না বলে চিকিৎসা দিতে বিলম্ব হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত হাসপাতালে আনা যায়, তত ভালো। এ ক্ষেত্রে সাড়ে চার ঘণ্টার বেশি বিলম্ব হওয়া সমীচীন নয়।
তিনটি উপস্থাপনায় মূলত একজন রোগী এলে তার চিকিৎসা কী, রোগীভেদে কীভাবে চিকিৎসা করতে হয়, সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। একটি উপস্থাপনায় নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ কান্তি দে বলেন, স্ট্রোকের চিকিৎসা দলগত কাজ। এই দলে রেডিওলজি, নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি, আইসিইউসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সম্পৃক্ততা থাকা চাই। তিনি আরও বলেন, জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য বেশ কিছু সরঞ্জাম (ডিভাইস) প্রয়োজন হয়। এগুলোর দাম অনেক বেশি। এগুলো রোগীকে কিনতে হয়। দরিদ্র রোগীর পক্ষে তা কেনা সম্ভব হয় না। সরকার ভর্তুকি মূল্যে বা বিনা মূল্যে এসব সরঞ্জাম বিএসএমএমইউসহ সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করলে অনেকের জীবন রক্ষা পেতে পারে। সেমিনারে অন্য প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামসুল আলম।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি চার গুণ বেড়ে যায়। রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
অন্যদিকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একইভাবে ঝুঁকি বাড়ায় ধূমপান। ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিয়মিত শরীরচর্চা, চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া, লবণ বা লবণযুক্ত খাবার কম খাওয়া, ধূমপান না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, মুখ বেঁকে যাওয়া, কথা বলতে পারছে না বা হঠাৎ এক চোখে দেখছে না—এমন সমস্যায় পড়লে মানুষ যেন বিএসএমএমইউতে চলে আসে। স্ট্রোকের রোগীর জরুরি চিকিৎসায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্ট্রোক সেন্টার’ খোলা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা এ সেন্টার খোলা থাকে।
সেমিনারের পরে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে স্ট্রোক সেন্টার আছে, যেখানে এসব রোগীর চিকিৎসা হয়। এর মধ্যে আছে বিএসএমএমইউ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, লাবএইড, স্কয়ার, এভারকেয়ার, বাংলাদেশ স্পেশালাইড হাসপাতাল, আসগর আলী হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিলেটের মাউন্ট অ্যাডোরা হাসপাতাল।