কী বই পড়বেন, কেন পড়বেন

শরচ্চন্দ্র দাস: নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি, হারুন রশীদ, প্রকাশক বাতিঘর।

বইমেলায় ভিড়ের জন্য হাঁটা যায় না। চট্টগ্রামের সিআরবির শিরীষতলার বাইরের চত্বরটায় সারি সারি খাবারের দোকানের বিক্রি চার-পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি বইয়ের বিক্রি। মানুষ খাচ্ছে বেশি, বই কিনছে কম। কিন্তু কেন? গত বুধবার মেলায় ঘুরতে ঘুরতে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। একটা বড় স্টলের সামনে বেশ কয়েকজন লেখক-পাঠকের ভিড়। তাঁদের কাছেই জানতে চাইলাম, কী বই কেনা যায় এবার মেলায়। তাঁদের একজন বললেন, ভালো বই কিন্তু এবারও মেলায় এসেছে, তবে প্রকাশের উত্তেজনা থিতিয়ে গেছে পাঠকের উদাসীনতায়।

মেলায় বরাবরের মতোই এবারও মননশীল বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ লক্ষ করা করা গেছে। মেলায় আকবর আলি খান, আলতাফ পারভেজ, আলী রীয়াজ, মহিউদ্দিন আহমেদের বই খুঁজছেন পাঠকেরা। তাঁদের বাইরে আনিসুজ্জামান, বদরুদ্দীন উমরের মতো লেখদের বইয়ের নতুন নতুন সংস্করণেরও চাহিদা বাড়ছে।

অভিযুক্ত: বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রকাশক প্রথমা।

এবার এমন তালিকায় নতুন সংযোজন হারুন রশীদের লেখা গবেষণাধর্মী ইতিহাস আশ্রয়ী বই শরচ্চন্দ্র দাস: নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি। শরচ্চন্দ্র দাসের মতো এমন বর্ণাঢ্য চরিত্র ব্রিটিশ ভারতে আর দ্বিতীয়টি ছিল না বললেই চলে। চট্টগ্রামের পটিয়ার এই সন্তান একই সঙ্গে ছিলেন অভিযাত্রী, পণ্ডিত ও ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কাউন্টার ইন্টিলিজেন্ট (গুপ্তচর)। পরিচয় গোপন করে নিষিদ্ধ তিব্বতে তিনি যেভাবে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তা এক কথা ছিল দুঃসাহসিক।

১৮৭৯ ও ১৮৮২ সালে দুই দফা সফরে তিব্বতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সখ্য হয়েছিল শরচ্চন্দ্রের। কিন্তু দ্বিতীয়বার ১৮৮২ সালে তিব্বত গিয়ে ১৪ মাস থাকার পর যখন ফিরে আসেন, তখন সে দেশের সরকারের কাছে তাঁর পরিচয় প্রকাশিত হয়। শরচ্চন্দ্রকে তিব্বত অভিযানে সহায়তা করা তিব্বতের বেশ কয়েকজন নাগরিককে এর মূল্যও দিতে হয়। ব্রিটিশ ভারতের গুপ্তচরকে সহায়তার দায়ে তাঁদের সবার মৃত্যুদণ্ড হয়। গত বেশ কয়েক বছর ধরে শরচ্চন্দ্র দাশকে নিয়ে গবেষণা করেছেন হারুন রশীদ। এই বই শরচ্চন্দ্রকে নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা বই, এ কথা বলাই যায়।

জয়নালের ইতালি যাত্রা, জাহেদ মোতালেব, চন্দ্রবিন্দু।

মননশীল বইয়ের পাশাপাশি উপন্যাসের প্রতিও পাঠকের সমান আগ্রহ রয়েছে। তবে অনেক পাঠকের অভিযোগ, কথাসাহিত্যে মনস্ক পাঠক কমছে। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, রশীদ করীম কিংবা শহীদুল জহিরের মতো লেখকের উপন্যাস পাঠের স্মৃতি বিজ্ঞপনের আড়ালে চাপা পড়ছে।  

তবে পাঠকের রুচি বদলের হাত ধরে এদেশের কথাসাহিত্যে নতুন বাস্তবতাও তৈরি হয়েছে, এ কথা বলাই যায়। হুমায়ূন আহমেদের তৈরি পাঠকশ্রেণি অন্যদের বই কেমন পড়ছেন, সেই বিচারে না গিয়েও বলা যায় আনিসুল হক, হরিশংকর জলদাস, বিশ্বজিৎ চৌধুরী কিংবা আসিফ নজরুলের নতুন পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। এই তালিকার প্রত্যেক লেখকের বই এখন ব্যবসা সফল। মেলায় বা বইয়ের দোকানে গিয়ে তাঁদের বইয়ের খোঁজ করেন পাঠকেরা।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বিশ্বজিৎ চৌধুরীর এবারের উপন্যাসের নাম অভিযুক্ত। এই উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া দেবযানী সাহা আর তাঁর শিক্ষক শাহজাহানকে কেন্দ্র করে। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর হঠাৎ একদিন দেবযানী যৌন হেনস্তার অভিযোগ তোলে শিক্ষক শাহজাহানের বিরুদ্ধে। অথচ এই ছাত্রীর সঙ্গে অধ্যাপকের ঘনিষ্ঠতা পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শাহজাহানের স্ত্রী তাসলিমার সঙ্গে ছিল দেবযানীর গভীর সখ্য। কিন্তু শাহজাহানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের ঘটনায় তাঁর সাংসারিক ও সামাজিক জীবনে ঝড় ওঠে। ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে উত্তপ্ত।

লাচুংয়ের রাত: ওমর কায়সার, চন্দ্রবিন্দু।

এই উপন্যাসে ভীষণভাবে সমকালকে ছুঁয়ে এগিয়েছে। দিন কয়েক আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক একই ধরনের একটি ঘটনাও ঘটে যায়। তবে এমন সব ঘটনার প্রতিক্রিয়ার ব্যক্তির মনোজগৎ কীভাবে বদলাতে থাকে, ঔপন্যাসিক তো সেটাই খুঁজে বের করেন। অভিযুক্ত সেদিক থেকে পাঠকের ভাবনার খোরাক জোগাবে।

মেলায় চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে কথাশিল্পী জাহেদ মোতালেবের উপন্যাস জয়নালের ইতালি যাত্রা। আফ্রিকার মরুভূমি, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ পথে এক বাংলাদেশির অভিবাসী হওয়ার গল্প বলেছেন লেখক। উপন্যাসের জয়নালকে পাঠকের খুবই পরিচিত মনে হবে। বিদেশের মাটিতে মানবপাচরকারীদের হাতে বন্দী জয়নাল যেন এদেশেরই শত শত অভিবাসীর মুখপাত্র হয়ে ওঠে।

কবিতার প্রতি একশ্রেণির পাঠকের বরাবরই পক্ষপাত আছে। তাঁদের জন্য ওমর কায়সারের নতুন কবিতার বই ‘লাচুংয়ের রাত’ এনেছে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন।

ভারতের সিকিম ভ্রমণের পটভূমিতে রচিত এই কাব্যগ্রন্থ একাধারে ভ্রমণকাহিনি আবার স্ফটিকস্বচ্ছ কবিতাও। শব্দের বরফকুচি সরিয়ে পাঠককে এই কাব্যের জগতে প্রবেশ করতে হবে। যাঁরা কবিতায় নির্জনতা খোঁজেন, তাঁদের জন্য এই বই। আসুন দু লাইন পাঠ করা যাক—

‘দার্জিলিংয়ের পাখিমেঘ/ এমন শীতল দুঃখে ওম দিয়ে চলে গেছে/ টাইগার হিলে অনন্ত সূর্যোদয়ের অপেক্ষার কাছে।/ লাচুংয়ের পর্বতশীর্ষে বরফকুচিতে/ ফুটে আছে সারদার মন।/ এ পাহাড় যতদূর যায়/ সঙ্গে থাকে সারদাকুণ্ড রায়।’ সারদা চলে গেলে, লাচুংয়ের রাত।

খড়িমাটি থেকে প্রকাশিত ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আল পথে বইটিও পাঠকের নজর কাড়বে। এ ছাড়া প্রথমা থেকে হরিশংকর জলদাশের উপন্যাস একটু দাঁড়াও, চন্দ্রবিন্দু থেকে প্রকাশিত আলম খোরশেদের সাক্ষাৎকার চতুষ্টয় বইও নতুন কিছু দেবে পাঠককে।