গণ–অভ্যুত্থানের রক্তিম পোস্টার প্রদর্শনী শুরু

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তীর পোস্টারের প্রদর্শনী। আজ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়ছবি: শুভ্র কান্তি

পোস্টার সাধারণত আমরা দালানের দেয়াল, প্রাচীর, বিবিধ প্রকার খুঁটি প্রভৃতির সঙ্গে সাঁটানো অবস্থায় দেখে অভ্যস্ত। তবে প্রযুক্তির বদৌলতে দিন জামানার অনেক রীতি–রেওয়াজ বদলেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এই রক্তিম পোস্টারগুলো সাঁটা হয়েছিল যে দেয়ালে, তা দালানকোঠার দেয়াল নয়, ফেসবুকের দেয়ালে। অসংখ্য দর্শক পোস্টারগুলো দেখেছিলেন। আন্দোলনের দিনগুলোতে এসব পোস্টার অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছিল আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তীর করা এসব পোস্টারের প্রদর্শনী শুরু হলো শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নিয়ে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের অনেকে হয়তো সামনে আসেননি। তাঁদের মুখ আমরা চিনি না। কিন্তু তাঁদের অবদান কম নয়। একই ভাবে বিদেশে থেকেও অনেকে এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী তাঁদের মধে৵ অন্যতম। তাঁর পোস্টারগুলো নতুন চিত্রভাষা তৈরি করেছিল।

প্রধান অতিথি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে অনেক নতুন শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। স্বৈরশাসকের প্রতিবাদের পাশাপাশি উদ্ভাবনী শক্তিরও বিকাশ ঘটেছে। গত ১৫ বছর উন্নয়নের নামে যে বয়ান তৈরি করা হয়েছিল, তা ভেঙে দিয়ে অসংখ্য গ্রাফিতির মাধ্যমে একটি নতুন বয়ান তৈরি হয়েছে। এই পোস্টার, এই গ্রাফিতি, এগুলো গণ-অভ্যুত্থানের নতুন বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।

বিশিষ্ট আলোকচিত্রী ও কিউরেটর শহিদুল আলম বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি অনেকে অনেকভাবে কাজ করেছেন। শিল্পীরা কার্টুন এঁকেছেন, অনেকে লেখালেখি করেছেন, দেবাশিস চক্রবর্তীর মতো অনেকে পোস্টার করেছেন এগুলো মনে রাখতে হবে।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও লেখক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজীবীদের অধিকাংশই স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি। আন্দোলনেও তাঁদের দেখা যায়নি। তাঁরা শিল্পী হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।

সভাপতির বক্তব্যে একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, শিল্প কেমন করে একই সঙ্গে রাজনৈতিক হাতিয়ার ও নান্দনিক হতে পারে এই পোস্টারগুলো তার দৃষ্টান্ত। একজন শিল্পী কীভাবে তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন, শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী এই কাজের ভেতর দিয়ে তা দেখিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভার্চু৵য়ালি যুক্ত হয়েছিলেন শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ২০১৮ সাল থেকেই তিনি ‘রাষ্ট্র যন্ত্রণা’ নামে একটি সিরিজ চিত্রকলার কাজ করছিলেন। এতে স্বৈরাচার সরকারের জুলুম–নির্যাতন, গুম–খুনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তিনি প্রতিদিন ঘটনাগুলো নজরে রাখতেন এবং পোস্টার করে ফেসবুকে পোস্ট করতেন। সাধারণ মানুষ যেন সহজে বিষয়বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হতে পারে, সে জন্য তিনি একটি স্বতন্ত্র চিত্রভাষা সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেছেন। সিনেমার পোস্টার, বিজ্ঞাপনচিত্র প্রভৃতি থেকে উপকরণের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তার সঙ্গে স্লোগান হিসেবে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা প্রয়োগ করেছেন।

এ ছাড়া অনুষ্ঠানে আমস্টারডাম থেকে লেখক ও গবেষক পারভেজ আলম ভার্চু৵য়ালি যুক্ত হন। বক্তব্য দেন একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক মুস্তফা জামান, স্বাগত বক্তব্য দেন প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক আবদুল হালিম।

এই প্রদর্শনীতে দেবাশিস চক্রবর্তীর ফেসবুকে পোস্ট করা পোস্টারগুলো থেকে বাছাই করা ২০টি পোস্টারের বিভিন্ন আকৃতির ডিজিটাল প্রিন্ট উপস্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে এগুলো এ আর-ভি আর (অগমেন্টেড-ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি) মাধ্যমেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রদর্শনীটি চিত্রশালার ৫ নম্বর গ্যালারিতে চলছে, প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে।

যা আছে: প্রদর্শনীকক্ষে প্রবেশ করলেই সামনের দেয়ালজুড়ে চোখে পড়বে এক বিশাল পোস্টার। তাতে দেখা যাচ্ছে, রাজপথে পড়ে আছে শহীদ হওয়া তরুণ বিপ্লবীর নিথর দেহ। গ্যালারির দেয়ালে দেয়ালে দেখা যাবে নানা আকারে সাজানো পোস্টারগুলো। ‘হাসিনাশাহি’র পুলিশ কোমরে হাত রেখে দাঁড়ানো। ওপরে লেখা ‘মাইরা তো ফেলছি এখন কী করবা’।

আরেকটি পোস্টারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দৃঢ়সংকল্প ছাত্র-ছাত্রী। তাতে লেখা ‘মাননীয় মাদার অফ গণহত্যাকারী পদত্যাগ করুন’। আরেকটি পোস্টরে সেই বিখ্যাত স্লোগান ‘তুমি কে আমি কে/রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার। আরেক পোস্টারে চপ্পল নিক্ষেপ করছে এক ক্ষিপ্ত তরুণ, ওপরে শুধু লেখা ‘আপা’। আরও আছে ‘আওয়াজ উডা কথা ক’, ‘রক্তাক্ত জুলাই’ লেখা পোস্টরে দেখা যাবে শহীদ হওয়া বন্ধুর লাশ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শোক ও বিস্ময়ে হতবিহ্বল তরুণ বিপ্লবী। অন্য এক পোস্টারে দেখা যাচ্ছে অস্ত্র তাক করে গুলি ছুড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক। পাশে লেখা ‘সব স্বাভাবিক’।

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এমন অনেক পোস্টারই এবার সামনে থেকে দেখতে পাবেন দর্শকেরা। গণ–অভ্যুত্থানের পারে সেই উত্তাল দিনের স্মৃতি জাগিয়ে রাখবে রক্তিম এই পোস্টারগুলো।