১৫ তলা দুই সরকারি ভবন খালি, বানানো হচ্ছে আরও চারটি
সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য খেলার মাঠ ও পাশের জমিতে ছয়টি ভবন করা হচ্ছে। মাঠটি রক্ষায় আন্দোলন হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের জন্য নির্মিত দুটি ১৫ তলার ভবন খালি পড়ে আছে সাড়ে তিন বছর ধরে। আরও চারটির নির্মাণকাজ চলছে ধীরগতিতে। ভবনগুলোতে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা থাকতে আগ্রহী হবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
যে জায়গায় আবাসন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে, সেটির নাম আলীগঞ্জ খেলার মাঠ। ২০১৬ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর প্রকল্পটি নেওয়ার সময় আপত্তি জানিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মাঠটি রক্ষার দাবিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সংগঠক ও শিশু-কিশোরেরা মানববন্ধন করেছিলেন, সড়ক অবরোধ করা হয়েছিল, জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল গণস্বাক্ষর। কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়নি।
ছয়টি ভবন করার প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। দুটি ভবনের কাজ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের জুনে।
আলীগঞ্জ শিল্প এলাকা। এখানে ধুলাবালি বেশি। সরকারি কর্মকর্তারা যে এখানে থাকতে আসবেন না, সে বিষয়ে আমরা আগেই সতর্ক করেছি। কেউ আমাদের কথা শোনেনি।কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আলীগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি কাউসার আহমেদ
অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার আগ্রহ থাকবে না বলেই নির্মাণকাজ শেষ হওয়া ভবন দুটি বুঝে নেওয়া হচ্ছে না। চারটির কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টাও কম। উল্লেখ্য, ভবনগুলো কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থা নয়, সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য।
আলীগঞ্জ খেলার মাঠ রক্ষায় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আলীগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি কাউসার আহমেদ গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলীগঞ্জ শিল্প এলাকা। এখানে ধুলাবালি বেশি। সরকারি কর্মকর্তারা যে এখানে থাকতে আসবেন না, সে বিষয়ে আমরা আগেই সতর্ক করেছি। কেউ আমাদের কথা শোনেনি।’
কাউসার আহমেদ বলেন, ‘কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা দরপত্র–বাণিজ্য করার জন্য শিল্প এলাকায় আবাসন প্রকল্প নিয়ে আসেন। যতটুকু জেনেছি, এখানে কেউ (সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী) আসতে চাইছেন না।’
সরেজমিন দেখা যায়, নির্মাণকাজ শেষ হওয়া দুটি ১৫ তলা ভবনে এক হাজার বর্গফুট করে ১৬৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। পাহারা দেন আনসার সদস্যরা। ভবন দুটির কোনো কাজ বাকি নেই। এমনকি লিফটও বসানো হয়েছে।
ব্যয় ৪০৪ কোটি টাকা
নথিপত্র অনুযায়ী, আলীগঞ্জে ছয়টি ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪০২ কোটি টাকা। পরে ২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। শুরুতে আটটি ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। তবে পরে তা কমিয়ে ছয়টি করা হয়। প্রতিটি ভবন হবে ১৫ তলা করে। ভবনগুলোতে ফ্ল্যাট থাকবে মোট ৫০৪টি, প্রতিটি ৮০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ছয়তলার একটি বিদ্যালয় ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে।
আবাসন প্রকল্পটির জমির পরিমাণ ১১ দশমিক ৬৫ একর। এর মধ্যে আলীগঞ্জ মাঠ ছিল ৫ দশমিক ৭০ একর জমিতে। গণপূর্তের দাবি, পুরো জমি তাদের। তবে বিষয়টি নিয়ে আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন বলে দাবি করেছেন স্থানীয় লোকজন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আটটির বদলে ছয়টি ভবন করা হচ্ছে আলীগঞ্জ মাঠের জন্য কিছু জায়গা রাখতে গিয়ে। তবে সেই মাঠ স্থায়ীভাবে উন্মুক্ত থাকবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। কারণ, মাঠসহ পুরো প্রকল্প এলাকায় সীমানাপ্রাচীর করার কাজ চলছে।
গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, ঢাকার সচিবালয় থেকে নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে সড়কপথে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটারের মতো। পোস্তগোলা হয়ে দুই লেনের সড়ক ধরে গেলে ফতুল্লা উপজেলার আলীগঞ্জে যেখানে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, সেই জায়গা সড়কের পাশে। আশপাশের এলাকায় নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা।
গণপূর্ত বলেছে, তারা ছয়টি ভবন একসঙ্গে বুঝে নেবে। তাই আমরা পাহারা দিয়ে রাখছি।নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এন হুদা কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী রবিউল আলম
রাজধানীর গুলিস্তান থেকে রোববার সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে বাসে রওনা দিয়ে প্রকল্প এলাকায় যেতে সময় লেগেছে ৫২ মিনিট। তবে পোস্তগোলা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার এই সড়ক খানাখন্দে ভরা। ধুলার কারণে টেকা দায়।
সরেজমিন দেখা যায়, নির্মাণকাজ শেষ হওয়া দুটি ১৫ তলা ভবনে এক হাজার বর্গফুট করে ১৬৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। পাহারা দেন আনসার সদস্যরা। ভবন দুটির কোনো কাজ বাকি নেই। এমনকি লিফটও বসানো হয়েছে। তবে ফ্ল্যাটে ধুলাবালির আস্তর এবং কোথাও কোথাও শেওলা জমেছে। জানালায় মরিচা পড়েছে।
প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে দুটি ভবন খালি পড়ে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এন হুদা কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী রবিউল আলম রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণপূর্ত বলেছে, তারা ছয়টি ভবন একসঙ্গে বুঝে নেবে। তাই আমরা পাহারা দিয়ে রাখছি।’
বাকি চারটি ভবনের কাজ প্রায় শেষ। দেয়ালে পলেস্তারা করা হয়েছে। রং করা, টাইলস লাগানো, লিফট বসানোসহ কিছু কাজ বাকি। তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভবনগুলোর কাজ শেষ দিকে এসেছে অনেক আগেই। এরপর গতি খুব ধীর হয়ে গেছে।
এই চার ভবনের দুটির নির্মাণকাজের দায়িত্ব পেয়েছে ঢালি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। দুটির ঠিকাদার ইকবাল কনস্ট্রাকশন এন্টারপ্রাইজ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা বলছেন, আগামী জুনে তাঁরা ভবন হস্তান্তর করতে পারবেন।
ঢালি কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মূল কাজ শেষ। এখন চলছে টাইলস ও দরজা-জানালা লাগানোর কাজ।
মেয়াদ বেড়েছে পাঁচবার
নথিপত্র অনুযায়ী, ভবন নির্মাণের প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল তিন বছর। কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে। তবে গণপূর্ত কাজ শেষ করতে পারেনি। এ কারণে মেয়াদ পাঁচ দফা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ ছয়টি ভবন করতে লাগবে ৯ বছর। অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে দুই কোটি টাকা।
ভবন নির্মাণে যে এত সময় লাগে না, তার উদাহরণ গণপূর্তের প্রকল্পেই আছে। যেমন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, পাবনার রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় ২০ তলার তিনটি ভবন করতে তাদের সময় লেগেছিল মাত্র ১৩ মাস।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ মোহাম্মদ জুবাইর প্রথম আলোকে বলেন, দুটি ভবনে চাইলে সরকারি কর্মকর্তারা উঠতে পারেন। তবে নাগরিক সুবিধা কিছুই এখন নেই। খেলার মাঠ, স্কুল, পার্ক, সীমানাপ্রাচীর—এসব এখনো হয়নি। সে জন্য হয়তো কেউ যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তিনি বলেন, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত হলে কর্মকর্তারা সেখানে যাবেন।
অবশ্য ঢাকার ভেতরেই সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য নির্মিত ভবনের অনেক ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। মিরপুর-৬ ও শিয়ালবাড়িতে গণপূর্ত অধিদপ্তর ১৪ তলার ১৬টি ভবন নির্মাণ শেষ করেছে প্রায় তিন বছর আগে। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থাকার পরও সেখানে থাকার আগ্রহ নেই সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে। ফলে নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে কেউ থাকবেন কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে।
একেবারে কাছাকাছি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখতে কেমন দেখায়? তাহলে আমাদের কাজ কী? এ বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু জবাব দিতে পারি না।আলীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা আক্তার
স্কুল আছে, তবু আরেকটি
আলীগঞ্জে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন প্রকল্পের ভেতরে ৯ কোটি টাকা ব্যয় করে একটি ছয়তলার স্কুল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। গণপূর্ত বলছে, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানেরা পড়াশোনা করবেন। অথচ সামান্য দূরে সরকারি দুটি পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। একটি আলীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। আরেকটি আলীগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়, যা ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত।
আলীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা আক্তার রোববার নিজ দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একেবারে কাছাকাছি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখতে কেমন দেখায়? তাহলে আমাদের কাজ কী? এ বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু জবাব দিতে পারি না।’
দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার পরও আরেকটি কেন, সে বিষয়ে গণপূর্ত বলছে, নতুনটি আপাতত ‘কমিউনিটি স্কুল’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বাসিন্দারা কমিটি করে এটি চালাবেন। পরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করা হবে।
মাঝখান দিয়ে ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠটি ছোট হয়ে গেল। এখন যেটুকু আছে, তা–ও রক্ষা করা যাবে কি না সন্দেহ আছে। কারণ, ইতিমধ্যে সরকারি আবাসন প্রকল্পের জন্য মাঠসহ চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছে।স্থানীয় বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন
সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প
সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নির্মাণ করা ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা খালি পড়ে থাকছে। প্রয়োজনীয়তা না দেখে, সমীক্ষা না করে এবং সুবিধা নিশ্চিত না করে শুধু স্থাপনা করা হয়। পরে তা কাজে লাগে না।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, আলীগঞ্জে ভবন নির্মাণের আগে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাবেন কি না, সে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়নি। সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের মতামতও নেওয়া হয়নি।
আলীগঞ্জের বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাবেন বলে তাঁরা মনে করেন না। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে ভবনের ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে আশপাশে শিল্পকারখানার কর্মচারীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হবে। আলীগঞ্জে সরকারি একটি সংস্থার আবাসন প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাঝখান দিয়ে ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠটি ছোট হয়ে গেল। এখন যেটুকু আছে, তা–ও রক্ষা করা যাবে কি না সন্দেহ আছে। কারণ, ইতিমধ্যে সরকারি আবাসন প্রকল্পের জন্য মাঠসহ চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছে।