এটুআইয়ে বেশি কাজ পেত ৩ কোম্পানি ও ‘আধিপত্য’ ছিল একজনের
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সরকারি প্রকল্প এটুআই ঘিরে একটি ‘সিন্ডিকেট’ বা চক্র গড়ে উঠেছে। তিন কোম্পানি বেশি সফটওয়্যারভিত্তিক কাজ পেয়েছে। এ ছাড়া শুরু থেকে প্রকল্পে চলে এসেছে এক ব্যক্তির ‘আধিপত্য’।
তিন কোম্পানি হলো অরেঞ্জ বিজনেস ডেভেলপমেন্ট (অরেঞ্জবিডি), ট্যাপওয়্যার সলিউশনস ও সফটবিডি। আর প্রকল্পে আধিপত্য বিস্তার করে আসা ব্যক্তি হলেন আনীর চৌধুরী। প্রকল্পে তাঁর সবশেষ পদ ‘প্রোগ্রাম অ্যাডভাইজার’। তাঁকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
দেশের ডিজিটাল উন্নয়নে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের সহযোগিতায় ২০০৬ সালে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। ২০২০ সালে প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)। প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে। সবশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালে।
এটুআই শুরু হয়েছিল ২৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে। বছর বছর তা বেড়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ব্যয় দাঁড়াবে ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৫৫ কোটি টাকার বেশি দিচ্ছে সরকার। বাকিটা উন্নয়ন সহযোগীরা। প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ (৮৫৫ কোটি টাকা) রাখা হয়েছে ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়ের জন্য।
এটুআই ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীন আসে। এটুআইয়ে কাজ করেছেন বা বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলেন, এমন একাধিক ব্যক্তি বলছেন, আইসিটি বিভাগের অধীন আসার পর প্রকল্পে অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যায়। এমনকি প্রকল্পের অধীন নেওয়া নানা উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এটুআইয়ের বর্তমান প্রকল্প পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে আইসিটি বিভাগ থেকে তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রতিবেদন এলে জানা যাবে, কারও কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল কি না।
৫০ শতাংশ কাজ চার কোম্পানির
এটুআইয়ে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪৬টি সফটওয়্যার কেনাকাটা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, একক ও যৌথভাবে ছয়টি করে কাজ পেয়েছে ট্যাপওয়্যার সলিউশনস, সফটবিডি ও বিজনেস অটোমেশন। একক ও যৌথভাবে পাঁচটি কাজ পেয়েছে অরেঞ্জবিডি।
সব মিলিয়ে ৪টি কোম্পানি পেয়েছে ২৩টি কাজ। বাকি ২৩টি কাজ একক ও যৌথভাবে পেয়েছে ২০টি কোম্পানি। তিনটি কোম্পানি—অরেঞ্জবিডি, ট্যাপওয়্যার সলিউশনস ও সফটবিডির বিরুদ্ধে এটুআইয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কেনাকাটার ক্ষেত্রে শর্ত এমনভাবে তৈরি করা হতো, যাতে তাঁরা কাজ পান।
বিশেষ করে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত ক্রয়সংক্রান্ত তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এই সময়কালে ১১টি সফটওয়্যার ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণসংক্রান্ত কাজ ছিল। এর মধ্যে একক ও যৌথভাবে সাতটি কাজই পেয়েছে অরেঞ্জবিডি, ট্যাপওয়্যার সলিউশনস ও সফটবিডি।
ট্যাপওয়্যার সলিউশনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. কামরুজ্জামান নিটন, অরেঞ্জবিডির সিইও আল আশরাফুল কবির জুয়েল ও সফটবিডির সিইও আতিকুল ইসলাম খান। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা সবাই দাবি করেছেন, যোগ্য হিসেবেই তাঁদের প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। কোনো বাড়তি সুবিধা নেননি তাঁরা।
আতিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, বেআইনিভাবে কাজ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আতিকুল ইসলাম খান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এটুআইয়ে পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কাজ করেছেন তিনি। ২০১৫ সালের মে মাস থেকে তিনি সফটবিডির সিইও হিসেবে কাজ শুরু করেন।
দরপত্রের শর্ত নিয়ে আপত্তি প্রকাশ্যে এসেছিল ২০২০ সালে। ওই বছর সেপ্টেম্বরে সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর একটি ক্রয় নিয়ে এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, দরপত্রে যে চারটি শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যে শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে, তা হাতে গোনা দু-একটি কোম্পানি ছাড়া অন্য কারও পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে কাজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করা থেকে বঞ্চিত হবেন। এ ধরনের অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করা অনুচিত।
প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দরপত্রে শর্তগুলো এমনভাবে দেওয়া হতো যে ঘুরেফিরে একই কোম্পানি ‘টেকনিক্যালি’ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে যেত। এটুআইয়ের প্রকিউরমেন্ট নথি ঘেঁটেও দেখা যায়, কাজ পাওয়া কোম্পানিগুলোর নম্বর অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি।
পিডির ওপর ‘পিডি’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর এটুআই প্রকল্পের ১৪ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরামর্শককে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয় আইসিটি বিভাগ। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে ৯ জনই ইউএনডিপি-বাংলাদেশ থেকে নিয়োগ করা পরামর্শক। তাঁদের মধ্যে আছেন আনীর চৌধুরী। অভিযোগের বিষয়ে আনীর চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইউএনডিপি-বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
জানতে চাইলে ই-মেইলে ইউএনডিপি-বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে বলা হয়, এটুআই-সম্পর্কিত অভিযোগের ব্যাপারে তারা অবগত। অভিযোগ ইউএনডিপির অফিস অব অডিট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনে জমা দেওয়া হয়েছে। তারা অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে দেখছে, আনুষ্ঠানিক তদন্তের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে কি না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একটি প্রকল্পের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা পরিচালক। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এটুআইয়ে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) থাকা সত্ত্বেও তাঁর মাথার ওপর থাকতেন আনীর চৌধুরী। তিনি শুরু থেকেই এই প্রকল্পে রয়েছেন। তাঁকে বলা হতো, প্রকল্পের ‘পলিসি অ্যাডভাইজার’। তবে এটুআইয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আনীর চৌধুরীর সবশেষ পদ ‘প্রোগ্রাম অ্যাডভাইজার’। তিনি ঘন ঘন বিদেশে যেতেন। বিভিন্ন সম্মেলন-ফোরামে তিনি অংশ নিতেন।
আইসিটি বিভাগ থেকে ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত যতজন বিদেশে গেছেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক। এরপর রয়েছেন আনীর চৌধুরী।
আইসিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আনীর চৌধুরীর নামে ১৬টি বিদেশ ভ্রমণের আদেশ জারি হয়। অবশ্য তাঁর বেশির ভাগ সফরের খরচ আয়োজক সংস্থার বহনের কথা আদেশে উল্লেখ ছিল।
আইসিটি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এটুআইয়ের অনানুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন আনীর চৌধুরী। দীর্ঘ সময় এই প্রকল্পে যুক্ত থাকায় তাঁর একচেটিয়া প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল। এ ছাড়া সাবেক আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেও প্রকল্পে তাঁর বাড়তি প্রভাব ছিল।
এটুআইয়ের কাজগুলোর অবস্থা
সরকারের মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, সংস্থা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ওয়েবসাইট তৈরি করে এটুআই। এ ছাড়া সরকারের বেশ কিছু সেবাকে তারা ডিজিটালাইজড করেছে। তবে প্রকল্পের পরের দিকে এসে এটুআইয়ের কাজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ই-কমার্স সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ‘একশপ’ চালু করেছিল এটুআই। এর কার্যক্রম এখন নীতিগত পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটুআই ২০১৯ সালে ই-পেমেন্ট সার্ভিস ‘একপে’ চালু করে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তাদের অনুমোদন ছাড়াই চালু হয় ‘একপে’।
সরকারের সব সেবা এক প্ল্যাটফর্ম থেকে দেওয়ার জন্য ২০১৯ সালে এটুআই চালু করে ‘একসেবা’। আবার একই উদ্দেশ্যে পরের বছর ২০২০ সালে চালু করা হয় ‘মাইগভ’। দুটির জন্যই আলাদা করে দরপত্র হয়। এখন একসেবার সাইটে ক্লিক করলে মাইগভে চলে যায়।
এটুআই ‘দপ্তর’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এর দুটি আলাদা ঠিকানা পাওয়া যায়। একটি সরাসরি সরকারি সাইট, আরেকটি ভেন্ডার প্রতিষ্ঠান ট্যাপওয়ারের নামে। দুটিতেই একই তথ্য রয়েছে। যোগাযোগের ঠিকানা ‘এটুআই’লেখা। ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ফর স্কিলস, এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম করে এটুআই। প্ল্যাটফর্মের সাইটে কোনো তথ্য নেই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ডিসেম্বরে এটুআই ৫৩ লাখ টাকার বেশি খরচ করে তৎকালীন সরকারের সাফল্য প্রচারে ‘মিশন ২০৪১: আমিই সল্যুশন’ নামের শো প্রচার করে।
তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিনেট ও আই সোশ্যালের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী অনন্য রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, এটুআই যখন শুরু হয়, তখন এর উদ্দেশ্যে ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটালাইজেশনে সহায়তা করা। কিন্তু পরবর্তী সময় তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন থাকাকালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে খবরদারি করে। তাদের পরামর্শকদের নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, এটুআই নিয়ে একটি মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। তারা কীভাবে চলছে, কাদের কাছে তারা দায়বদ্ধ, তাদের কাজগুলো বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা খতিয়ে দেখা দরকার।