ডোনাল্ড লুর চিঠি
শর্তহীন সংলাপ চায় যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে গতকাল। আওয়ামী লীগকেও চিঠি দেওয়া হবে।
বাংলাদেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পাশাপাশি দেশটি তাদের ভিসা নীতির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে এ–সম্পর্কিত চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগকেও চিঠি দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এই চিঠি লিখেছেন।
ডোনাল্ড লুর চিঠির ব্যাপারে গতকাল ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি এক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে শর্তহীন সংলাপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার এবং সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছে। মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বিবৃতিতে এ–ও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত করে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে বিএনপি এখন তাদের আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে থাকার কথা বলছে।
ক্ষমতাসীন দল বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে রয়েছে। গতকালই সাংবাদিকদের প্রশ্নে ইসির সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, ‘নভেম্বরের প্রথমার্ধে (১৫ নভেম্বর) তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।’
এমন পটভূমিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে প্রধান তিন দলকে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানাল যুক্তরাষ্ট্র। আর এই আহ্বান জানানো হলো যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠির মাধ্যমে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই চিঠি পৌঁছে দিতে গতকাল ঢাকার বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিএনপিও চিঠি পেয়েছে। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল সোমবার রাত সোয়া নয়টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ডোনাল্ড লুর চিঠি পেয়েছেন। এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
■ যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার এবং সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।
■ শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র।
■ যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতির কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে।
গতকাল রাত পৌনে ১০টায় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি তখনো পায়নি আওয়ামী লীগ।
এর আগে গত ৩১ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের কাছে আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন যে রাজনৈতিক দলগুলো শর্তহীন সংলাপে বসবে।
তবে শর্তহীন সংলাপে বসার যুক্তরাষ্ট্রের যে আহ্বান, সে ব্যাপারে গতকাল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। জাতীয় পার্টির নেতারা অবশ্য বলেছেন, তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চান। প্রধান দুই দল এখন পরস্পরবিরোধী যে অবস্থানে গেছে, তাতে শর্তহীন সংলাপের প্রশ্নে সন্দেহ রয়েছে জাতীয় পার্টির নেতাদের।
এদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গতকাল বিকেলে জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ডোনাল্ড লুর চিঠি হস্তান্তর করেছেন। সে সময় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা হয়েছে বলে জানান জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। সেই বৈঠকের পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চিঠিতে মূলত তিনটি বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন দেখতে চায়। দ্বিতীয়ত, শর্তমুক্তভাবে সংলাপের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতি নিয়েছে, চিঠিতে তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বেলা তিনটায় পিটার হাসের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের বৈঠক শুরু হয়। বৈঠক চলে প্রায় ৪০ মিনিট। বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মুজিবুল হক ছাড়াও দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও বিশেষ দূত মাসরুর মওলা উপস্থিত ছিলেন।
মুজিবুল হক বলেন, ডোনাল্ড লুর চিঠিতে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। তবে জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছে।
ডোনাল্ড লুর চিঠির ব্যাপারে গতকাল ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাতেও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়।
রাজনৈতিক সংকট সমাধানে শর্তহীন সংলাপে বসার বিষয়টিই যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠির মূল বিষয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন। তাঁরা মনে করেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘাত হচ্ছে। অন্যদিকে গ্রেপ্তারের মুখে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীরা আত্মগোপনে থেকে অবরোধের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। সংলাপের মাধ্যমেই এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের কথা বলে আসছে। এখন তারা লিখিতভাবে বলল। এটি দলগুলোর ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। কিন্তু তিনি মনে করেন, গ্রেপ্তার অভিযানসহ সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে বিএনপির সারা দেশের নেতা–কর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন এবং সম্প্রতি তাদের ১০ হাজারের মতো নেতা–কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ অবস্থায় বিএনপি শর্তহীন সংলাপে আসবে কি না, এ সন্দেহ তাঁর রয়েছে।
তবে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংলাপের মাধ্যমে সমাধান না হলে এবং সংঘাতের মধ্যে নির্বাচন হলে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে।