সুনামগঞ্জে বন্যা: ‘বইন্যায় আমরার কমর ভাঙিলায়’

সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমছে। তবে এখনো ডুবে আছে অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও স্থাপনা। এমন একটি রাস্তায় নৌকা দিয়ে চলাচল করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। গতকাল বিকেলে সদর উপজেলার কালীপুর গ্রামেছবি: খলিল রহমান

‘ঘরো অখনও আটু (হাঁটু) পানি। ঈদের দিন থাকি হখলরে নিয়া বাড়ি ছাড়ছি। ঠিকমতো খাওন নাই, ঘুম নাই। ঘরের ধান-চাউল, খেতা-বালিশ সব নষ্ট অইছে। পরতি বছর বইন্যায় আমরার (আমাদের) কমর ভাঙিলায়।’ উঠানে কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে নিজের এমন অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন শ্রমিক আলাউদ্দিন (৫০)। বৃষ্টি থামায় পাঁচ দিন পর গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঘরবাড়ির সর্বশেষ অবস্থা দেখতে এসেছেন তিনি।

আলাউদ্দিনের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কালীপুর গ্রামে। তাঁর বসতঘরের ভেতর দেখা গেল হাঁটুপানি জমে আছে। এর কাঁচা বেড়ার কিছু অংশ পানির তোড়ে ধসে গেছে। হেলে পড়েছে রান্নাঘর। শুধু আলাউদ্দিন একা নন, গ্রামটির বেশির ভাগ মানুষের ঘরবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকেছে। এ অবস্থায় অনেকেই চলে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। তাঁদের ঘরে তালা ঝুলছে। গ্রামটির প্রধান সড়কও পানিতে ডুবে আছে। সেখানেও চলছে নৌকা।

হাওরপারের এই গ্রামের পাশে হাসনবসত ও নতুনহাটি নামের আরও দুটি গ্রাম আছে। তিন গ্রামে মিলে তিন শর কাছাকাছি পরিবারের বসবাস। গ্রামগুলোর মানুষ নানা পেশার সঙ্গে জড়িত হলেও অধিকাংশই কৃষিকাজ করেন। আর বর্ষা এলে হাওর-বাঁওড়ে মাছ ধরতে নামেন।

বন্যায় দরিদ্র মানুষের ক্ষতি বেশি হয় বলে মন্তব্য করেন আলাউদ্দিন। তিনি জানান, কোনো রকমে টেনেটুনে পাঁচজনের সংসার চলে। বন্যায় যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, সেটি কাটিয়ে উঠতে এক বছর লাগবে। এখন প্রায় প্রতি বছর বন্যা হচ্ছে। এ কারণে প্রতিবারই ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা।

কালীপুর গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে আলাউদ্দিনের বসতঘর। এর চালা টিনের ও বেড়ার কিছু অংশেও টিন ব্যবহার করা হয়েছে। উঠানের এক পাশে ছোট্ট রান্না ঘরটি একদিকে হেলে পড়েছে। তাঁর উত্তর পাশে বিল্লাল আমিনের ঘর। ঘরটির দরজায় তালা ঝুলছে। কিছুক্ষণ পরই বিল্লাল এলেন পানিতে অর্ধেকটা গা ডুবিয়ে। তিনি জানালেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে উপজেলা পরিষদে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। ঘরের পানি নামতে আরও তিন-চার দিন লাগতে পারে বলে তাঁর ধারণা।

এখনো অনেক ঘর–বাড়ি ও স্থাপনায় জমে আছে পানি। গতকাল বিকেলে সদর উপজেলার কালীপুর গ্রামে
ছবি: খলিল রহমান

ষাটোর্ধ্ব শামসুদ্দিন একটি ছোট নৌকা নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে সহধর্মিণী রাবিয়া বেগম। এই দম্পতি জানালেন, ঘরে পানি প্রবেশ করার পর সবাইকে নিয়ে গ্রামের একটি নির্মাণাধীন ভবনে উঠেছেন। আরও কয়েকটি পরিবার আছে সেখানে। পানি কিছুটা কমায় ঘরের অবস্থা দেখতে এসেছেন তাঁরা।

রাবিয়া বেগম আক্ষেপের স্বরে বললেন, ‘পাঁচ দিন ধইরা একটা বিল্ডিংয়ে আছি, কিলা আছি কেউ খোঁজ নিছে না। কোনো সাহাইয্য পাইলাম না। কষ্টের কথা কারে কইতাম।’
এবারের বন্যায় সুনামগঞ্জে ভোগান্তিতে পড়েছেন জেলার কয়েক লাখ বাসিন্দা। জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, বন্যায় প্লাবিত হয়েছে অন্তত ১ হাজার ১৮টি গ্রাম। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন প্রায় আট লাখ মানুষ।

দুদিন সুনামগঞ্জে ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কম হওয়ায় সুরমা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে পানি নামছে ধীরে। এক দিকে পানি কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ছে।

আরও পড়ুন

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গত রোববার (১৬ জুন) দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। মঙ্গলবার একই সময় পানি বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। চার দিন পর আজ শনিবার সুরমা নদীর পানি এখানে বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। সকাল ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৭৮ মিটারে, যা বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচে। সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। প্রথম দিকে সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা আক্রান্ত হলেও পরে জেলার সব উপজেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। ছাতক, সদর, দোয়ারাবাজার উপজেলায় অসংখ্য বাড়িঘরে এখনো পানি আছে। রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়ে আছে। দিন যত যাচ্ছে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি ততই বাড়ছে। অনেকের ঘরে খাবারের সংকট আছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা।

সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম দিকে সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা আক্রান্ত হলেও পরে জেলার সব উপজেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। ছাতক, সদর, দোয়ারাবাজার উপজেলায় অসংখ্য বাড়িঘরে এখনো পানি আছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে; আরও হবে। গত দুই দিন সুনামগঞ্জ এবং ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কম হওয়ার কারণেই নদীর পানি কমছে।  

বন্যা দুর্গতদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এ ছাড়া ত্রাণ বিতরণও করা হচ্ছে।