ডাকের এই দুর্দিন পোড়ায় কামরুল হককে
চিঠি চালাচালির চল আজকাল তেমন নেই। এককালে যোগাযোগের জনপ্রিয় এই মাধ্যমটির জায়গা দখল করেছে প্রযুক্তি। এখন মুঠোফোনে নিমেষেই কথা বলা যায় সবার সঙ্গে, দেখা যায় ভিডিও। ফলে আগের সেই জৌলুশ হারিয়েছে ডাক বিভাগ। রাস্তার ধারে একাকী পড়ে থাকা ডাকবাক্সগুলোর আশপাশে দু–একজনকে দেখা যায়, তা–ও বলতে গেলে সরকারি চিঠির জন্য। এই বিষয়গুলো নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন কামরুল হক।
কামরুল হক ১৯৮২ সালে ডাক বিভাগে এলবি পিয়ন পদে চাকরি শুরু করেন। পরে ১৯৮৭ সালে বিভাগের পেইন্টার পদ খালি হলে তিনি ‘নিজ ইচ্ছায়’ ওই পদে যোগ দেন। বাংলাদেশে এই পদ একটিই। দুই বছর আগে ওই পদ থেকে অবসরে যান তিনি। তবে পেইন্টার পদটি খালি থাকায় এখনো ডাক বাক্স রং করা এবং ডাক বাক্স বসানোর জন্য ডাক পান কামরুল হক। ডাক বাক্স রং করলে ৫০০ টাকা আর নতুন করে বাক্স বসানোর জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা পান তিনি।
‘ডাক বিভাগের যে জৌলুশ ছিল, তা দেখেছেন কামরুল হক। দেশে ব্যক্তিগত চিঠির সংখ্যা কমে গেছে। এ চিত্র সারা বিশ্বেই। সব জায়গায় ডাক বাক্স কমে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে ডাক বাক্স চেনেও না। তবে কামরুল হককে যাঁরা চেনেন, সবাই তাঁর নাম মনে রাখবেন’
ডাক বিভাগের জমজমাট দিনগুলোর কথা সম্প্রতি প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন কামরুল হক। তিনি বললেন, কোনো এলাকায় ডাক বাক্স বসাতে হবে কি না, তা তদন্ত করে দেখতেন তিনি। ডাক বাক্স খোলার সময়সূচি লিখতেন। ডাক বাক্সে, বিভাগের পুরোনো পরিবহনের গায়ে, ডাক কাউন্টারে রংতুলির আঁচড়ে লিখতেন বিভিন্ন বার্তা। কামরুল হকের ভাষ্যমতে, ‘বাংলাদেশ ডাক বিভাগ’, ‘রাষ্ট্রীয় ডাক’, ‘রাষ্ট্রীয় ডাক পরিবহন’—এ ধরনের লেখাগুলো যেন দূর থেকে পড়া যায় সে জন্য মোটা ও বড় অক্ষরে লেখা শুরু করেন তিনি।
ডাক বিভাগের প্রয়োজনে লেখা বিভিন্ন শব্দের ভুল বানান সংশোধনে ভূমিকা রেখেছিলেন বলে দাবি কামরুল হকের। ‘পোষ্ট মাষ্টার’ বানানটিতে ‘ষ’ না হয়ে ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘স’ ব্যবহার করতে হবে, সেটি নাকি তিনিই শুধরে দিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, কামরুল হকের দাবি, আগে বিভাগের কর্মকর্তাদের চেয়ারের পেছনে পদবি লেখার সময় পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘জনাব’ ও নারীদের ক্ষেত্রে ‘জনাবা’ লেখা হতো। এ নিয়ে আপত্তি জানান তিনি। কারণ, জনাবা অর্থ ঋতুমতী নারী। তাই জনাবার বদলে ‘বেগম’ বা ‘মিসেস’ শব্দটি লিখতে শুরু করেন।
ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি পছন্দ করতেন কামরুল হক। পত্রিকার ছবি দেখে তা খাতায় স্কেচ করতেন। কেউ বনভোজনে গেলে গাড়ির সামনে বড় করে বনভোজন কথাটি লিখে দিতেন। চালু করেছিলেন তরুণ সংঘ, সৌরভ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
টানা ৩৭ বছর ডাক বিভাগে চাকরি করেছেন কামরুল হক। তাঁর চাকরিজীবনের বড় একটি সময়ের সঙ্গে বর্তমান চিত্রকে মেলাতে পারেন না তিনি। আক্ষেপ করে একটি হিসাব তুলে ধরলেন প্রথম আলোর কাছে। কামরুল হক বলেন, ঢাকা শহরে চিঠির বাক্স ৩৩৬টি থেকে কমতে কমতে ১২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। আগে দুই বেলা চিঠির বাক্স খোলা হতো। একেকবার কয়েক বস্তা করে চিঠি পাওয়া যেত। এখন দুই দিনেও হয়তো ডাক বাক্সে চিঠি পড়ে না।
পুরান ঢাকা আহসান মঞ্জিলের ফটকে ডাক বাক্সে এক বছরে একটিও চিঠি পড়েনি বলে প্রথম আলোকে জানালেন কামরুল হক। এই তথ্য জানানোর পর ডাক বিভাগ কর্তৃপক্ষ নাকি বলেছিল, বাক্সটি শুধু ঐতিহ্য হিসেবে টিকে থাকবে। এগুলো দেখে মন খারাপ হয় কামরুল হকের। তিনি বললেন, কোনো একটি বাক্স বিশেষ করে প্রেসক্লাব, কোর্ট–কাছারি এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গার ডাক বাক্সে রং করে আসার পরই দেখা যায় মানুষ তাতে পোস্টার লাগিয়েছে, পানের পিক ফেলেছে, চুন লাগিয়ে দিয়েছে। মাদকসেবীরাও ডাক বাক্সের তালা খুলে নিয়ে যায়।
ডাক বিভাগের বর্তমান দুর্দশা নিয়ে কামরুল হকের মন খারাপ হলেও এখনো কাজের জন্য ডাক পাচ্ছেন। তিনি বললেন, একসময় হয়তো ডাক বাক্সই থাকবে না। আর ডাক বাক্স থাকলেও হয়তো তাঁকে আর ডাকা হবে না। হয়তো বা বয়সের জন্য কাজটি করতে পারবেন না। তখন কামরুল হকের নামও হারিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক বিভাগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল কাজী ইসমত জেরীন প্রথম আলোকে বলেন, ডাক বিভাগের যে জৌলুশ ছিল, তা দেখেছেন কামরুল হক। দেশে ব্যক্তিগত চিঠির সংখ্যা কমে গেছে। এ চিত্র সারা বিশ্বেই। সব জায়গায় ডাক বাক্স কমে গেছে।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকে ডাক বাক্স চেনেও না। তবে কামরুল হককে যাঁরা চেনেন সবাই তাঁর নাম মনে রাখবেন।
১৯৭০ সাল থেকে রাজধানীর ফকিরাপুলে ডাক বিভাগের কলোনিতে ছিলেন কামরুল হক। তাঁর বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। ২১ বছর হলো তিনি মারা গেছেন। তারপর নিজের চাকরির সূত্রেই কলোনিতে থেকে গেছেন তিনি। অবসরে যাওয়ার পর বর্তমানে রাজধানীর গোড়ানে বসবাস করেন।
শুধু কামরুল হক বা তাঁর বাবা নন, ডাক বিভাগে কাজ করেছেন তাঁর পরিবারের আরও বেশ কয়েকজন। তাঁর এক ভাই ডাক বিভাগের কেরানি ছিলেন। ওই ভাইয়ের স্ত্রী এসি স্ট্যাম্প বিভাগে কাজ করতেন।
দুজনই তাঁদের মেয়ের সঙ্গে এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। আরেক ভাইও ডাক বিভাগে কেরানি হিসেবে ছিলেন। কামরুল হকের আরেক ভাই এসি স্ট্যাম্প বিভাগে কাজ করছেন। এভাবে পরিবারের অনেকেই ডাক বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
৬২ বছর বয়সী কামরুল হকের মনে চাকরিজীবনের কিছু বিষয় নিয়েও আক্ষেপ আছে। বললেন, পেইন্টার পদে কাজ করলেও তিনি এই পদের বেতন কখনো পাননি। তিনি যে পদে চাকরি শুরু করেছিলেন সেই পদেরই বেতন পেয়েছেন। এ ছাড়া এত বছর পেইন্টার পদে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে কাজ করলেও ডাক বিভাগ থেকে কোনো স্বীকৃতিও মেলেনি।
ঢাকা নগরী দক্ষিণের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল কাজী ইসমত জেরীন বললেন, তিনি কাজ শুরু করার আগেই কামরুল হক অবসরে যান। তবে কামরুল হককে যেহেতু এখনো কাজের জন্য ডাকা হয়, সেই সূত্রে পরিচয় আছে। কামরুল হকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকায় নিয়োগবিধি অনুযায়ী হয়তো তিনি পেইন্টার পদের বেতন পাননি। তবে বছর বছর ইনক্রিমেন্টসহ অন্যান্য সুযোগ পেয়েছেন। স্বীকৃতি পাওয়া প্রসঙ্গে ডাক বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ব ডাক দিবসে সেরা কর্মীদের পুরস্কৃত করা হয়। কামরুল হক এ পর্যন্ত এমন কোনো সম্মাননা পেয়েছেন কি না, তা তাঁর জানা নেই।
পিয়ন পদে চাকরি শুরু করলেও পরে কেন নিজ ইচ্ছায় পেইন্টার পদে যোগ দিলেন, প্রথম আলোর কাছে তা তুলে ধরলেন কামরুল হক। বললেন, ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি পছন্দ করতেন। পত্রিকার ছবি দেখে তা খাতায় স্কেচ করতেন। কেউ বনভোজনে গেলে গাড়ির সামনে বড় করে বনভোজন কথাটি লিখে দিতেন। চালু করেছিলেন তরুণ সংঘ, সৌরভ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
আঁকাআঁকির পাশাপাশি কামরুল হক ছড়া লিখতেন, নাটক লিখতেন, তাতে অভিনয়ও করতেন। পোস্ট অফিস হাইস্কুলের ব্যানারে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘কিশলয়’ নামের একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। তবে কামরুল হকের বাবা চাইতেন না ছেলেমেয়েরা আঁকাআঁকি করুক। বাবার ভয়ে অন্যরা সব ছেড়ে দিলেও তিনি ছাড়েননি বলে জানান কামরুল হক।
তবে অভাবের কারণে ১৯৮২ সালে চাকরি শুরু করেন তিনি। পরে ১৯৮৯ সালে বিয়ে করেন। এরপর থেকে আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিচরণ কমতে থাকে তাঁর। কামরুল হক জানালেন, ঋদি হকের ১৯৭১ সালের সেই সব দিন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। জাজ মাল্টিমিডিয়ার ‘পাপ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘হিরামন’ নাটক আবার শুরু হয়েছে। তাতেও অভিনয় করেছেন। আর ইগল মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে এখনো অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন।
কামরুল হকের তিন মেয়ে। তাঁদের মধ্যে দুজনের বিয়ে হয়েছে। অন্য এক মেয়ে স্নাতকের ছাত্রী ছিলেন। তবে টাকার অভাবে তাঁর পড়াশোনা আপাতত বন্ধ। আর এইচএসসি পড়ুয়া এক ছেলে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি দোকানে কাজ করছেন। প্রথম আলোকে এসব জানাতে গিয়ে কামরুল হক বললেন, পেনশনের টাকার সঙ্গে অভিনয় করে যা পান, তার সঙ্গে ছেলের আয় যোগ করে সংসার চলছে কোনোমতে।