আওয়ামী লীগ নেতার স্বার্থে অটোরিকশায় নতুন যন্ত্র

‘ফর হায়ার’ ও ‘হায়ার্ড’ শব্দ প্রদর্শনের যন্ত্র আমদানি করছেন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। যন্ত্রটি না থাকলে ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে না।

অটোরিকশায় ‘ফর হায়ার’ ও ‘হায়ার্ড’ শব্দ প্রদর্শনের যন্ত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে বিআরটিএছবি: সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোনো মহানগরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিটারে চলাচল করে না। যাত্রীদের চাহিদা মেনে গন্তব্যে যেতে চান না অধিকাংশ চালক। পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) গত দুই দশকেও আইন মেনে অটোরিকশার চলাচল নিশ্চিত করতে পারেনি।

অটোরিকশা মিটারে চলাচল নিশ্চিত করতে না পারলেও নীতিমালার একটি ছোট্ট ধারা বাস্তবায়নে তোড়জোড় শুরু করেছে বিআরটিএ। সেটি হচ্ছে অটোরিকশা ভাড়ার জন্য উন্মুক্ত থাকলে ‘ফর হায়ার’ এবং ভাড়ার পর ‘হায়ার্ড’ শব্দ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গত ২৯ এপ্রিল একটি পরিপত্র জারি করেছে সরকারি সংস্থাটি। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কোনো কোনো কর্মকর্তা অটোরিকশায় এই যন্ত্র লাগানোর পেছনে যাত্রীদের কোনো স্বার্থ দেখছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা ও ব্যবসায়ীর কোম্পানির যন্ত্র বিক্রি নিশ্চিত করতেই বিআরটিএ নীতিমালার এই অংশ বাস্তবায়ন করতে নেমেছে। ওই ব্যবসায়ী হচ্ছেন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তারেক শামস খান ওরফে হিমু। তাঁর প্রতিষ্ঠান টপ-২ এই যন্ত্র সরবরাহ করে। তিনি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, তারেক শামসের প্রতিষ্ঠান নিজেদের পণ্য বিক্রির লক্ষ্যে ২০২১ সালে বিআরটিএতে আবেদন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ ২৯ এপ্রিল সিএনজি ও পেট্রলচালিত অটোরিকশায় ফর হায়ার এবং হায়ার্ড শব্দ প্রদর্শনের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করে। অটোরিকশায় এই শব্দ দুটি প্রদর্শনের যন্ত্র না থাকলে ফিটনেস সনদ না দিতেও নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। অথচ অতীতে এই যন্ত্র না থাকলে ফিটনেস সনদ দেওয়ার বিষয়ে কখনোই কড়াকড়ি আরোপ করেনি বিআরটিএ।

বিআরটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ফর হায়ার ও হায়ার্ড শব্দগুলো প্রদর্শন করে কী লাভ? নীতিমালার মূল বিষয় হচ্ছে, যাত্রীদের চাহিদামতো মিটারে গন্তব্যে যেতে বাধ্য থাকবেন অটোরিকশার চালকেরা। এটাই নিশ্চিত করা যায়নি।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, শুরুতে অটোরিকশার মিটারের সঙ্গে ফর হায়ার ও হায়ার্ড যন্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা চালু ছিল। মিটার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান যন্ত্রটি বিনা মূল্যে গাড়িতে দিত।

সড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী প্রথম আলোকে বলেন, কাউকে ব্যবসায়িক সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। তাঁরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।

মূল লক্ষ্য ব্যবসা

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর মিলিয়ে প্রায় ২৮ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের অনুমতি আছে। বছর বছর প্রতিটি অটোরিকশার ট্যাক্স-টোকেন হালনাগাদ করতে হয়। নিতে হয় ফিটনেস সনদ। ফর হায়ার ও হায়ার্ড লেখাসংবলিত যন্ত্র না বসালে এখন আর সনদ দেওয়া হচ্ছে না।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, প্রতিটি যন্ত্রের দাম নেওয়া হচ্ছে ২ হাজার টাকা। সে হিসাবে অটোরিকশার মালিকদের কাছে এই যন্ত্র বিক্রি করে প্রায় ৫ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। যন্ত্রটি চীন থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এগুলোর দাম সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।

সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আগে মিটারের সঙ্গে দেওয়া যন্ত্রটি ছোট ছিল। ফলে সেটা ভেতরেই স্থাপন করা যেত। টপ-২ প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রটি আকারে বড়। অটোরিকশার রেক্সিনের ছাদ ফুটো করে লাগাতে হয়। এতে বৃষ্টিতে অটোরিকশার ক্ষতি হচ্ছে। যন্ত্রটিও বৃষ্টিতে ভিজে বিকল হয়ে যেতে পারে।

অটোরিকশার চালক ও মালিকেরা বলছেন, এই যন্ত্র বেশি দিন সচল রাখা যাবে না। ফলে বছর বছর ২ হাজার টাকায় যন্ত্রটি কিনতে হবে। নতুবা ফিটনেস সনদ পাওয়া যাবে না।

টপ-২ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক শামস খান প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালায় থাকায় তাঁরা বিআরটিএর কারিগরি কমিটিতে বিষয়টি উপস্থাপনের পর সবাই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, অন্য কোনো কোম্পানি কারিগরি কমিটিকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তাঁরাও যন্ত্রটি বিক্রি করতে পারবেন।

নীতিমালায় যা আছে

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের নীতিমালা অনুযায়ী, অটোরিকশাচালক রুট পারমিট এলাকার ভেতরে যেকোনো গন্তব্যে মিটারে যেতে বাধ্য থাকবেন। মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত দাবি বা আদায় করতে পারবেন না।

বিষয়টি সড়ক পরিবহন আইনেও সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নীতিমালা অমান্য করলে শাস্তি হিসেবে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু বাস্তবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, কিছু মানুষের ব্যবসা করার সুযোগ দিতেই বিআরটিএ এই উদ্যোগ নিয়েছে। এতে অটোরিকশার চালক ও মালিকেরা হয়রানির শিকার হবেন।