ব্রাহ্মণপাড়া শিদলাই গ্রাম
৮৮ বছর পর শান্তির আবহ
ব্রাহ্মণপাড়া শিদলাই গ্রামের দুই পক্ষের মধ্য ১৯৩৩ সালে বিরোধ শুরু হয়। উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় শনিবার ওই বিরোধের অবসান হয়।
ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে প্রায়ই টেঁটা, বল্লম ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই গ্রামের দুটি পক্ষ। সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে তিনজন। আহত হয়েছেন অনেকে। এসব ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা হতো। এসব মামলার কিছু আসামি কারাগারে আর কিছু পালিয়ে বেড়াতেন। অবশেষে ৮৮ বছরের বিরোধের অবসান হয়েছে। ওই দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির আবহের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বিরোধে না জড়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই পক্ষ শপথ করেছে। গত শনিবার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজের মাঠে সম্প্রীতি সভায় তারা শপথ নেয়। শিদলাই শান্তি পরিষদ এই সভায় আয়োজন করে। এতে দুই দলের সদস্যরা টেঁটা, বল্লম ও লাঠিসোঁটা জমা দিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই একটি বড় গ্রাম। এক গ্রাম নিয়েই একটি ইউনিয়ন। ১৯৩৩ সালে এই ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মানুষের মধ্যে প্রথম মারামারি হয়। এরপর থেকে গ্রামে দুটি পক্ষ তৈরি হয়। এর মধ্যে একটির নাম বড় দল এবং অপরটির ছোট দল। বড় দলের নেতৃত্বে রয়েছেন জাহাঙ্গীর মিয়া ও লিটন মিয়া। ছোট দলের নেতৃত্বে শিদলাই ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অহিদ মিয়া। এ পর্যন্ত দুই দলের সংঘর্ষে মারা গেছেন তিনজন। মামলা হয়েছে ১৮টি। আসামি হয়েছেন ৬০০ জন। গ্রেপ্তার–আতঙ্কে পালিয়ে বেড়িয়েছেন ২৫০ জন।
দীর্ঘমেয়াদি এই বিবাদ মেটানোর জন্য ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল রানাকে সভাপতি ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপ্পেলা রাজু নাহাকে সদস্যসচিব করে ১০ সদস্যের ‘শান্তি পরিষদ’ নামে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রধান উপদেষ্টা সাংসদ আবুল হাসেম খান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ জাহের এবং উপজেলার আট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওই কমিটির সদস্য।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘদিনের বিরোধ শেষ করার জন্য শান্তি পরিষদ গত কয়েক মাস ধরে শিদলাই গ্রামের বড় দল ও ছোট দলের সঙ্গে পৃথক সভা করে। তাদের কাউন্সেলিং করে। রাজধানী ঢাকা থেকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এনে দুই পক্ষের লোকদের সচেতন করা হয়। কথায় কথায় মারামারি করার পেছনের খারাপ দিক তুলে ধরা হয়। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। এতে বড় দলের পক্ষে মোশারফ হোসেন ও ছোট দলের পক্ষে অহিদ মিয়া সই করেন। এটি শিদলাই শান্তি চুক্তিনামা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
৪ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে দুই পক্ষে শান্তিচুক্তি হয়। ৯টি শর্তে ওই চুক্তি হয়। ওই চুক্তিগুলো হচ্ছে শিদলাই ইউনিয়নে আর কোনো দল থাকবে না, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা, ৮৮ বছরের ঘটনার পটভূমি নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তৈরি করা, শিদলাই শান্তি পরিষদ কমিটির দুই পক্ষের কার্যক্রম মনিটরিং করা, ব্রাহ্মণপাড়া থানার উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে মাঠে ‘শান্তির পাহারাদার’ নামে একটি কমিটির কাজ করা, দুই পক্ষের অস্ত্র জমা দেওয়া, কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা, সম্প্রীতি বাড়াতে দুই পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত দেওয়া হয়েছে। ওই শর্তে বলা হয়, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বড় দলের হামলায় ছোট দলের ১৭ জন পঙ্গুত্ব বরণ করে ও ৫৫টি ঘর নষ্ট হয়। আর্থিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো দেড় কোটি টাকা পাবে। এর মধ্যে যাঁদের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা ১ কোটি ২০ লাখ এবং যাঁরা পঙ্গু হয়ে গেছেন, তাঁরা ৩০ লাখ টাকা পাবেন। সঠিকভাবে ওই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পুনর্বাসন কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটিতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সহসভাপতি, আট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও শিদলাই কলেজের অধ্যক্ষ সদস্য পদে থাকবেন।
এসব শর্তের ভিত্তিতে গত শনিবার দুপুরে শিদলাই আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রি কলেজের মাঠে শিদলাই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে এক সম্প্রীতি সভা হয়।