দীর্ঘ ৫৫ বছর পর চালু হতে যাচ্ছে নীলফামারীর চিলাহাটি ও ভারতের হলদিবাড়ী মধ্যে রেল যোগাযোগ। আর এ পথে আজ বৃহস্পতিবার আরেক ধাপ এগিয়ে গেল দুই বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের আকাঙ্ক্ষা। ভারতের হলদিবাড়ী অংশে রেলপথ সংযোগ স্থাপনের কাজ শেষে আজ ভারতীয় একটি রেলইঞ্জিন পরীক্ষামূলক চলাচল করল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে।
আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভারতের কুচবিহার জেলার হলদিবাড়ী সীমান্ত রেলস্টেশন পেরিয়ে ইঞ্জিনটি বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছায়। সেখানে ১০ মিনিট অবস্থানের পর পুনরায় ছেড়ে যায় হলদিবাড়ীর উদ্দেশে। পরে ওই সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় রেল বিভাগের কর্মকর্তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
বাংলাদেশ সীমান্ত ছুঁয়ে ভারতীয় রেলইঞ্জিনের এই পরীক্ষামূলক চলাচল সাড়া ফেলেছে সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে। ৫৫ বছর পর দুই সীমান্ত ছোঁয়া এলাকায় ভারতীয় রেলের উপস্থিতিতে সীমান্তের উভয় পাশে ভিড় জমে দুই দেশের উৎসুক মানুষের। তারা দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রেল চলাচল দেখতে। সীমান্তের দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা উপভোগ করে স্বপ্নপূরণের সন্ধিক্ষণের দৃশ্যটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রানুযায়ী, এই পরীক্ষামূলক রেল চলাচলের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের উত্তর-পূর্ব রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী জে পি সিং, উপপ্রধান প্রকৌশলী ভি কে মিনা ও নির্বাহী প্রকৌশলী পি কে জে। এ সময় ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আবদুর রহীম, নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান উদ্দিন ও উপসহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম।
৫৫ বছর পর দুই চিলাহাটি-হলদিবাড়ী এলাকায় ভারতীয় রেলের উপস্থিতিতে সীমান্তের উভয় পাশে ভিড় জমে দুই দেশের উৎসুক মানুষের। তারা দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রেল চলাচল দেখতে। সীমান্তের দুই ধারে দাঁড়িয়ে তারা উপভোগ করল স্বপ্নপূরণের সন্ধিক্ষণের দৃশ্যটি।
ওই দৃশ্য উপভোগ করতে ছয় কিলোমিটার দূর থেকে সেখানে এসেছিলেন জেলার ডোমার উপজেলার কেতকীবাড়ী ইউনিয়নের ঠাটারীপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম (৮০)। এ সময় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আগে এ পথে ট্রেন চলেছিল। শুনেছি সে ট্রেনে আমাদের এলাকার লোক ভারতের কলকাতা পর্যন্ত ঘুরে আসত। এরপর বন্ধ হলে দীর্ঘ ৫৫ বছর পর ভারতের রেল দেখতে পেলাম।’
গত মঙ্গলবার বিকেলে ডোমার উপজেলার চিলাহাটি সীমান্তের ৭৮২ নম্বর পিলারের কাছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতিতে হলদিবাড়ী-চিলাহাটি রেলপথের সংযোগ স্থাপিত হয়। ওই পথেই ভারতের অংশে আজ বৃহস্পতিবার পরীক্ষামূলক রেল চলাচল করল।
রেলওয়ে সূত্রমতে, ১৯৬৫ সালের পর চিলাহাটি-হলদিবাড়ী পরিত্যক্ত রেলপথটি চালুর উদ্যোগ নেয় দুই দেশের সরকার। ভারত হলদিবাড়ী রেলস্টেশন থেকে সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ করলেও তাদের অংশে জিরো পয়েন্টে ১৫০ মিটার অবশিষ্ট ছিল। গত মঙ্গলবার বিকেলে ওই অংশের কাজ শেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেয় ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট পাক-ভারত বিভক্তের পরও এ পথে রেল চলাচল চালু ছিল। সে সময় এ পথে দুই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলাচল করত যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর বন্ধ হয় দুই দেশের মধ্যে রেল চলাচল। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও আর চালু হয়নি এ পথে রেল চলাচল।
উদ্বোধন ডিসেম্বর কিংবা মার্চে
দুই দেশের মধ্যে বন্ধ থাকা রেলপথটি চালু করতে ৮০ কোটি ১৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয় বর্তমান সরকার। প্রকল্পটির মধ্যে রয়েছে চিলাহাটি রেলস্টেশন থেকে সীমান্ত পর্যন্ত ৬ দশমিক ৭২৪ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ, ২ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার লুপলাইন নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামোর নির্মাণকাজ। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর চিলাহাটি রেলস্টেশন চত্বরে প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট চিলাহাটির জিরো পয়েন্টে ভারত-বাংলাদেশ সংযোগস্থলে রেলপথের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন তিনি। এ সময় তিনি জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা ২০২১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি এ পথে রেল চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
চিলাহাটি স্টেশনমাস্টার মো. মোমিন উদ্দিন প্রামাণিক দুই দেশের সীমান্তে রেলপথ সংযোগ স্থাপন সম্পন্নের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ভারতীয় অংশে বাংলাদেশের পরীক্ষামূলক রেল চলাচলের বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আবদুর রহীম বলেন, ভারত তাদের অংশে রেলপথের নির্মাণকাজ শেষে পরীক্ষামূলক রেল চলাচলের কাজও শেষ করেছে। বাংলাদেশ অংশে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষামূলক রেল চালানো হবে।
মূলত চলবে পণ্যবাহী ট্রেন
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার শ্রী সঞ্জিব কুমার ভাটী বলেছেন, খুব শিগগিরই চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেলপথ চালু হবে। ইতিমধ্যে নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পরীক্ষামূলকভাবে ভারত থেকে একটি ইঞ্জিন চিলাহাটি-হলদিবাড়ী জিরো পয়েন্টে এসে গেছে।
আজ বিকেল পাঁচটার দিকে জেলা শহরের কালীবাড়িমন্দির পরিদর্শনকালে ভারতের সহকারী হাইকমিশনার সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, আপাতত এ পথ দিয়ে শুধু পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করবে। তবে চিকিৎসার জন্য দুই দেশের মানুষ চলাচল করতে পারবে এ রেলপথ দিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে চিকিৎসা ভিসা চালু করেছি। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এ রেলপথ উদ্বোধন করলেই যাঁরা চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চান, তাঁরা সহজেই যেতে পারবেন।’
কালীবাড়িমন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি অক্ষয় কুমার রায়ের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সেকেন্ড সেক্রেটারি সঞ্জিব জেন, কালীবাড়িমন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস রায়, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেন্দ্র নাথ বর্ধন, সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দীপক চক্রবর্তী, নারী ভাইস চেয়ারম্যান সান্ত্বনা চক্রবর্তী প্রমুখ।