৫৫ বছর পর কাল চালু হচ্ছে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল যোগাযোগ
দীর্ঘ ৫৫ বছর পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার আবার চালু হতে যাচ্ছে নীলফামারীর চিলাহাটির সঙ্গে ভারতের হলদিবাড়ীর রেল যোগাযোগ। রেলপথে ভারত-বাংলাদেশ তথা দুই বাংলার সংযোগ স্থাপনের ওই মাহেন্দ্রক্ষণ ঘিরে চিলাহাটি রেলস্টেশনে এখন সাজ সাজ রব। স্টেশন–সংলগ্ন এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে এক হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার বিশাল আকারের প্যান্ডেল।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই রেল যোগাযোগের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি বড় পর্দায় দেখানো হবে প্যান্ডেলে। রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম উপস্থিত থাকবেন চিলাহাটির অনুষ্ঠানস্থলে।
ব্রিটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতে এই অঞ্চলে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান রেলপথ ছিল চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুট। এই পথ দিয়ে দার্জিলিং থেকে খুলনা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত একাধিক যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেন নিয়মিত চলাচল করত। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর রেলপথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে স্থবির হয়ে পড়ে নীলফামারীসহ আশপাশের জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য। তখন থেকেই ব্যবসায়ীসহ এলাকার মানুষের দাবি ছিল পুনরায় এই রেলপথ চালুর। এই দাবিতে কয়েক দশক ধরে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ ৫৫ বছর পর রেলপথটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয় দুই দেশের সরকার।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর এই পথ বন্ধ হয়। এরপর বর্তমান সরকার বন্ধ থাকা রেল লিংক ২০১৫ সালে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়। উদ্বোধনের পর এ পথে বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল, ভুটান পর্যন্ত যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। ঢাকা থেকে ভারতের দার্জিলিং যাওয়ার জন্য এটি অন্যতম প্রধান রুটে পরিণত হবে।
নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ী সীমান্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানোর কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। ৮০ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পে রেললাইন স্থাপন ছাড়াও বসানো হয়েছে ৪ কিলোমিটার লুপ লাইন, ৮টি লেভেল ক্রসিং, ৯টি ব্রিজসহ অন্যান্য অবকাঠামো। সব নির্মাণকাজ শেষে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়েছে বাংলাদেশ অংশে। এরপর চিলাহাটি রেলস্টেশনকেও আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
পাশাপাশি বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতও হলদিবাড়ী থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ করে তাদের অংশে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালিয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে তাদের অংশেও নেওয়া হয়েছে নানা প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রবেশদ্বারে ভারতের অংশে রেলপথের ওপর স্থাপন করা হয়েছে স্থায়ী তোরণ। ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন উপলক্ষে ওই তোরণকে সাজানো হয়েছে রঙিন সাজে।
রেলওয়ে সূত্রমতে, আগামীকাল দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন বহু কাঙ্ক্ষিত এই রুটের। উদ্বোধন ঘোষণার পর চিলাহাটি রেলস্টেশন থেকে পণ্যবাহী একটি ট্রেন ছেড়ে যাবে ভারতের হলদিবাড়ীর উদ্দেশে। ওই রেলবহরে থাকবে ভারতীয় ৩২টি খালি ওয়াগন। আর রেলবহরটিকে টেনে নিয়ে যাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি ইঞ্জিন। এসব ওয়াগন হলদিবাড়ী রেলস্টেশনে রেখে পুনরায় সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে ফিরে আসবে ইঞ্জিনটি।
গত বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) নীলফামারীতে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এই রেলপথ উদ্বোধনের প্রস্তুতিমূলক সভা। ওই সভায় রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম জানান, ১৭ ডিসেম্বর উদ্বোধনের পর থেকে এ পথে দুই দেশের মধ্যে আপাতত পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করবে। আগামী ২৬ মার্চ থেকে এ পথে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে দ্রুত যাত্রী পারাপারে ইমিগ্রেশনসহ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়নের দাবি ব্যবসায়ীদের। এ বিষয়ে নীলফামারী শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান জেলা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ সরকার বলেন, তাঁদের প্রত্যাশা ছিল পূর্ণাঙ্গ একটি স্থলবন্দরের। সেটা ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটি স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই আলোকে রেলসংযোগ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছে সরকার। চিলাহাটি-হলদিবাড়ী যে রেল লিংকটির সূচনা ঘটছে, এর মধ্যে উত্তরবঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের যুগান্তকারী একটি পরিবর্তন ঘটবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন। এখান থেকে সরাসরি মোংলা বন্দরের রেল সংযোগ থাকায় মোংলা বন্দরের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে নেপাল, ভুটান ও ভারতের সেভেন সিস্টারখ্যাত (অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা) রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের একটি ভালো লিংক স্থাপিত হবে।
বৃহস্পতিবার ১৭ ডিসেম্বর পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে দুই দেশের রেল যোগাযোগের উদ্বোধনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ৫৫ বছর পর পুনরায় এ পথে ভারত-বাংলাদেশ রেল যোগাযোগের সূচনা ঘটবে।
ওয়াহেদ সরকার বলেন, তবে ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল চিলাহাটিকে পূর্ণাঙ্গ একটি স্থলবন্দরে রূপান্তরের। রেল সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সেই পথেই আগানো যাচ্ছে। এরপরও দ্রুত ইমিগ্রেশন স্থাপন করে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের দাবি থাকবে তাঁদের।
চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল লিংক স্থাপনের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুর রহিম বলেন, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর এই পথ বন্ধ হয়। এরপর বর্তমান সরকার বন্ধ থাকা রেল লিংক ২০১৫ সালে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়। সে লক্ষ্যে ২০১৮ সালে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল লিংকটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন বর্তমান রেলমন্ত্রী ও ভারতীয় হাইকমিশনার। ইতিমধ্যে রেললাইন স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে। ভারতও তাদের অংশের কাজ শেষ করেছে। উভয় অংশে পরীক্ষামূলক ট্রেনও চালানো হয়েছে। উদ্বোধনের পর এ পথে বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল, ভুটান পর্যন্ত যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। ঢাকা থেকে ভারতের দার্জিলিং যাওয়ার জন্য এটি অন্যতম প্রধান রুটে পরিণত হবে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী এই পথে আগামী ২৬ মার্চ থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, বৃহস্পতিবার ১৭ ডিসেম্বর পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে দুই দেশের রেল যোগাযোগের উদ্বোধনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ৫৫ বছর পর পুনরায় এ পথে ভারত-বাংলাদেশ রেল যোগাযোগের সূচনা ঘটবে।