১৮৭ কোটি টাকার কাজের অগ্রগতি নেই

গত বছরের ডিসেম্বরে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। গত ২৩ সেপ্টেম্বর কাজের মেয়াদ শেষ হয়। আবার মেয়াদ ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

রাজশাহী নগরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড বড়বনগ্রাম রায়পাড়ায় নালা দিয়ে পানি নামতে না পারায় রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বাশেঁর আড় বানিয়ে চলাচল করছে মানুষ। গতকাল বড়বনগ্রাম রায়পাড়া এলাকাছবি: শহীদুল ইসলাম

রাজশাহী নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য হাতে নেওয়া হয়েছে ১৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকার প্রকল্প। কাজের মেয়াদ গত ২৩ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে গেছে। এখনো ছয়টি ওয়ার্ডে উন্নয়নের একটি ইটও লাগেনি। বাকি ওয়ার্ডগুলোতে কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের হিসাবমতে, কাজের গড় অগ্রগতি মাত্র ১৬ শতাংশ। এ অবস্থায় কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ মেয়াদেও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ‘রাজশাহী মহানগরের সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’–এর অধীনে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ১ হাজার কোটি টাকার কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়নকাজের জন্য ১৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ওয়ার্ডগুলোতে সড়ক–নালা সংস্কার ও নির্মাণ করা হবে। এ কাজ করছেন ঢাকার ঠিকাদার তানভীর আহমেদ। ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর তাঁকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। তিনি গত ফেব্রুয়ারি মাসে কাজ শুরু করেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর এ কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে কাজের মেয়াদ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

সম্প্রতি নগরের চারটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেল, কাজ শুরু হওয়া ও না হওয়া সব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা দুর্ভোগে আছেন।

কিছুই করা হয়নি, এমন দুটি ওয়ার্ড হচ্ছে নগরের ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ড। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৮টি রাস্তা ও ৩৬টি ড্রেন এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে। এ প্রকল্পে ৪ কোটির টাকার বরাদ্দ রয়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরমান আলী বললেন, এমনভাবে প্রকল্প করা হয়েছে যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে তাঁর ওয়ার্ডে আর কোনো উন্নয়নকাজ করার প্রয়োজন পড়বে না। জনগণ উন্নত নগরজীবনের সুবিধা ভোগ করবে। অথচ ঠিকাদারের কাজের মেয়াদ একবার শেষ হয়ে গেছে। তাঁর ওয়ার্ডে একটি ইটও ফেলা হয়নি।

এই ঠিকাদার আমাদের একটু বিপদে ফেলে দিয়েছেন। তাঁর বড় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু অলিগলির রাস্তা করার অভিজ্ঞতা নেই।
এ এইচ এম খায়রুজ্জামান, রাজশাহী সিটি মেয়র

২৪ নম্বর ওয়ার্ডের হাদীর মোড় নদীর ধারের বাসিন্দা মামুনুর রশিদ (৫৫) বলেন, বৃদ্ধ মানুষ এ রাস্তায় হাঁটতে পারেন না। আট-দশ বছর আগে ইট বিছিয়ে এ রাস্তা করা হয়েছে। এখন ভেঙেচুরে উঁচু–নিচু হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। পা পিছলে পড়ে যেতে হয়। চলতে–ফিরতে খুবই কষ্ট।

নগরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডেও কাজ শুরু হয়নি। এ ওয়ার্ডের বোসপাড়া কালীপুকুর এলাকার মধুসূদন বাবু নামের একজন বাসিন্দা বললেন, ১০ বছর আগে তাঁদের এ ইট বিছানো রাস্তাটি হয়েছিল। তখন কোনো নালা ছিল না। পরে নালা হলে পাশের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের যত পানি এসে এই সড়ক ডুবে যায়। এক দিন বৃষ্টি হলে সাত দিন নর্দমার নোংরা পানির ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় তাঁদের।

এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহতাব হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তার দরপত্র হয়েছে। কিন্তু ঠিকদার কাজ করেন না।

নগরের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ ওয়ার্ডে ৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকার কাজ হওয়ার কথা। ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম বললেন, গত মেয়াদে তিনি কাউন্সিলর হতে পারেননি। তাঁর আগের মেয়াদের শেষের দিকে যে রাস্তাগুলো সংস্কারের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, রাস্তাগুলো এখনো সেই অবস্থাতেই আছে। বর্ষায় মানুষের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে যায়। বড় রাস্তা নির্মাণ করার জন্য মালামাল পরিবহন করতে গিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরের সব রাস্তা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কিছু উন্নয়নকাজ করার জন্য ভেতরের রাস্তাগুলোও নষ্ট করে ফেলেছে। এটি একটি সম্প্রসারিত ওয়ার্ড কোনো পরিকল্পনা ছাড়া মানুষ যে যেভাবে পেরেছে, বাড়িঘর করেছে।

ঠিকাদার তানভীর আহমেদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মুঠোফোন থেকে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ঠিকাদার আমাদের একটু বিপদে ফেলে দিয়েছেন। তাঁর বড় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু অলিগলির রাস্তা করার অভিজ্ঞতা নেই। তাঁর লোকবলও কম। এখন কাজ শুরু করেছেন। তাঁকে সিটি করপোরেশনের লোকবল দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আশা করা যায়, আগামী এপ্রিলের মধ্যে তিনি একটি পর্যায়ে নিয়ে আসবেন।’

রাজশাহী মহানগরের সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১২ কোটি টাকার কাজ চলছে। প্রকল্পের অধীনে ২০টি রাস্তা ও ২০টি ড্রেন রয়েছে। কাউন্সিলর শাহাদত হোসনে বলেন, ঠিকাদার তানভীর তাঁর প্রকল্পের এক কোটি টাকার কাজও করেননি।

গত শনিবার এই ওয়ার্ডের বড়বনগ্রাম রায়পাড়ায় গেলে কথা হয় রাজমিস্ত্রি মো. ইয়াসিন আলীর (৩০) সঙ্গে। তিনি বলেন, রায়পাড়াসহ পাশের ৪ হাজার ৭০০ পরিবার জলাবদ্ধতা বলতে গেলে সারা বছরই লেগে থাকে।

পাশের হাজিপাড়ার নূরুল হুদার স্ত্রী আসমা বেগম (৫৫) বলেন, ‘আমহারে দুঃখ লিবারণ করার কেউ নাই। নিজের বাড়ি থাইক্যা বাইর হওয়ার লাইগ্যা ৫ হাজার টাকা দিয়ে বাঁশের আড় বানাইছি। এক প্রতিবেশী অসুস্থ হইল। তাকে একটা চাদরে লিয়া চারজন ধইরি পানি পার করতে করতেই মর‌্যা গেল।’

এই প্রকল্পের পরিচালক ও সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্বিত হয়েছে। ঠিকাদার কাজের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। তাঁকে কাজ করেই যেতে হবে।