২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

হ্যান্ডমাইকওয়ালা 'পাগল' জাকিরের কাজই এখন 'তুলনাহীন'

করোনাভাইরাস বিষয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত জকির হোসেন। বুধবার দুপুরে ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাস বিষয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত জকির হোসেন। বুধবার দুপুরে ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

বয়স বিবেচনায় তিনি অন্তত আর তরুণ নন। তবে মনটা তার তারুণ্য আর ভালো কিছু করার প্রত্যয়ে ভরা। এমনকি মানুষ হাসিঠাট্টা করলে বা ‘পাগল’ বললেও এই অবস্থান থেকে নড়েন না। ঘুরে বেড়ান হাটবাজার, গ্রামগঞ্জ, রাস্তাঘাটে। মানুষ দেখলেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কী কী করতে হবে ও কী কী করা যাবে না, সে বিষয়ে কথা বলতে থাকেন। হাতে সম্বল বলতে আছে শুধু একটা হ্যান্ডমাইক।

এই ব্যক্তির নাম মো. জাকির হোসেন মণ্ডল (৪১)। তাঁকে এখন নিয়মিতই দেখা যায়, ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায়। পেশায় একজন ভুসিমাল ব্যবসায়ী জাকির। তিনি কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামের মৃত সোবহান মণ্ডলের ছেলে। দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা তিনি।

গত ২৭ মার্চ থেকে এভাবে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন জাকির। এ জন্য আড়াই হাজার টাকা দিয়ে হ্যান্ডমাইকটা কিনেছেন। সেটা হাতে নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন এলাকার বিভিন্ন অলিগলি। সাধারণত হেঁটেই প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। শুধু দূরের কোনো বাজারে যেতে হলে মোটরসাইকেলে চড়েন। সকাল সাতটায় শুরু হয় এই কার্যক্রম। দূরের কোথাও না গেলে দুপুরে বাড়িতে এসে খেয়ে যান জাকির। আর আশপাশের এলাকায় থাকলে প্রচারণা চালিয়ে ফেরেন বিকেল গড়িয়ে গেলে। বয়স চল্লিশ পেরোলেও তাঁর পথচলায় আছে তারুণ্যের সব ছোঁয়া।

জাকির হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু একজনমাত্র ব্যক্তি হয়ে সারা দেশকে একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাহলে তিনি কেন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না? মূলত এ বোধ থেকেই এই কাজে নেমে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণই তাঁকে এ কাজে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

জাকিরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষই অসচেতন। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কী কী করতে হবে, তা জানেন না। আবার যারা জানেন, তাঁদের নিয়মকানুন মানতে গড়িমসি ভাব লক্ষণীয়। প্রথম প্রথম যখন জাকির মাঠে নামেন, তখন এলাকাবাসী তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত। ডাকতো ‘পাগল’ বলে। তবে যতই দিন যাচ্ছে, ততই মানুষ বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারছে। এখন অনেকেই তাঁর পাশেও দাঁড়াচ্ছেন।

জাকির বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ তাঁর গ্রামের রাম ঘোষ (২৮), জাহিদ মোল্লা (৪২) ও সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কাজীর (৪৬) প্রতি। তাঁরা নানাভাবে তাঁকে এই প্রচারণার কাজে সহযোগিতা করছেন। জাকির এই প্রচারণার পাশাপাশি অন্য একটা কাজও করেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা করোনার প্রাদুর্ভাব থাকা এলাকা থেকে কেউ কেউ এলাকায় চলে এসেছেন। তাঁদের ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) থাকা কথা। সবাই যাতে এটা মানেন, সেই চেষ্টা করছেন জাকির। এমন লোকজনকে বিষয়টি মানার জন্য প্রথমে অনুরোধ করেন তিনি। এতে কাজ না হলে পুলিশের কাছে বিষয়টি জানিয়ে দেন।

আবার কোয়ারেন্টিন মানা বা ভাইরাসের বিস্তার এড়াতে সাধারণ মানুষের ঘরে থাকার পথে বড় বাঁধা আর্থিক অসংগতি। সেটি বিবেচনায় নিয়ে ইউনিয়নের দরিদ্র ৮০টি পরিবারকে পাঁচ কেজি করে চাল কিনে দিয়েছেন জাকির। এ জন্য তিনি কারও কাছ কোনো আর্থিক অনুদান নেননি। নিজেই পুরো টাকা খরচ করছেন। এর বাইরে হ্যান্ডমাইক কেনার পাশাপাশি মোটরসাইকেলের তেল খরচ আছে। সবই তিনি করেছেন নিজের উদ্যোগে। শুধু পরিচিত একজন জাকিরকে একটি ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) জোগাড় করে দিয়েছেন।

জাকির বলেন, ‘আমরা তো বর্তমানে যুদ্ধেই লিপ্ত রয়েছি। যদিও আমাদের শত্রু আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু অদৃশ্য সেই শত্রু প্রাণহানিসহ নানাভাবে আমাদের ক্ষতি করছে। সেটা তো দৃশ্যমান। এ অবস্থায় সবাই সচেতন না হলে রক্ষা নেই। নিজেকে বাঁচাতে, সমাজকে রক্ষা করতে, দেশের সর্বনাশ রোধ করতেই সচেতন হতে হবে।’

এলাকার মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছেন জাকিরের এই প্রচারণার গুরুত্ব। তবে তাঁর স্ত্রী ফাহিমা বেগম তা বুঝেছেন আগেই। তিনি চোখের সামনে দেখছেন, লোকটা সারা দিন মাইক হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন; লোকজনকে সচেতন করছেন। প্রথমদিকে এলাকার লোকজন যখন স্বামীকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত, তখন খুব খারাপ লাগত ফাহিমার। এখন অনেকে জাকিরের কথার গুরুত্ব বুঝতে পারায় তাঁর খুব ভালো লাগে।

জাকিরের প্রচারণার গুরুত্ব বোঝেন মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা প্রণব চক্রবর্তী। জেলা জজ আদালতের এই নাজিরের ভাষায়, জাকির নিজের উদ্যোগে যে কাজ করে চলেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর কথাগুলো শুনে সবাই সচেতন হলেই কেবল বৈশ্বিক এই বিপদ থেকে এই এলাকার মানুষ দ্রুত রক্ষা পাবেন বলে বিশ্বাস করেন প্রণব।

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম বলেন, ‘জাকির নিজ উদ্যোগে যে কাজ করছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর মতো সব এলাকাতেই কেউ কেউ এগিয়ে এলে, তাঁদের কথায় এলাকার লোকজন সচেতন হলে, আমরা দ্রুতই এ বিপর্যয়কর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারব।’