হোটেলে খান, রাস্তায় ঘোরেন, পথে ঘুমান তাঁরা

রাস্তায় হাঁটা মানুষ হাতি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে আবার পথ চলছে। অনেকে আরও কাছ থেকে দেখার জন্য মাঠের ভেতরে চলে আসছে। আজ মঙ্গলবার সকালে খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে
ছবি: উত্তম মণ্ডল

সবে ভোর হয়েছে। সূর্যের আলো তখনো সেভাবে ছড়ায়নি। এরই মধ্যে খুলনার সার্কিট হাউস মাঠে একে একে জড়ো হতে শুরু করেছে নানা বয়সী মানুষ। মাঠের একটি অংশে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ফুটবল খেলার প্রস্তুতি চলছে। আরেক অংশে চলছে হালকা ব্যায়াম। বাইরের রাস্তার দলে দলে মানুষ হাঁটছে। এক কোণে দুটি গাছের মাঝে পলিথিনের তাঁবু টাঙিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কয়েকজন তরুণ–যুবক। তাঁবুর পাশে অন্য দুটি গাছে শিকলে বাঁধা একটি হাতি কলাগাছ খেতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পরপর খাওয়া থামিয়ে শুঁড় দিয়ে ধুলো তুলে নিজের পিঠে ছড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে মুখে হুংকার দেওয়ার মতো শব্দ করছে।

রাস্তায় হাঁটা মানুষ হাতি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে আবার পথ চলছে। অনেকে আরও কাছ থেকে দেখার জন্য মাঠের ভেতরে চলে আসছে। অনেকেই আবার সাতসকালেই হাতির সঙ্গে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। কেউ কেউ আবার তাঁবুর মধ্যে ঢুঁ মেরে হাতির মালিকের খোঁজ করছে; প্রশ্ন করার চেষ্টা করছে। তবে তাঁবুর মধ্যে থাকা চার যুবকের কোনো রা নেই। ভাবখানা এমন—তাঁদের জাগাতে পারে এমন সাধ্য কার!

টিবি ক্রস রোডের তোফাজ্জেল হোসেন প্রতিদিন এই এলাকা দিয়ে হাঁটেন। তাঁর মতে, অনেক বছর পর এই মাঠে হাতির দেখা পাওয়ায় মানুষের কৌতূহল বেশি।

দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর তাঁবুতে থাকা একজন আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন। মাঠে তখন আরও লোক জমতে শুরু করেছে। হাতি নিয়েও উৎসাহ বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চারজনের তিনজনই উঠে গেলেন ঘুম থেকে। কিছুতেই কথা বলতে চায় না তাঁরা। একপর্যায়ে দলের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ যুবকের মর্জিতে আলাপ জমল। দলের চারজনের মধ্যে তিনজনের বাড়ি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার জিন্দারপুরের মোলামগাড়িতে। অন্যজন সিলেটের জৈন্তাপুরের। চারজনই হাতিটির মাহুত। হাতিটির নাম লক্ষ্মী।

জানা গেল, হাতির মালিকের বাড়ি সিলেট। চার যুবক হাতিটিকে দেখভাল করার জন্য বেতনভুক্ত কর্মচারী। কারও বেতন মাসে ১০ হাজার, আবার কারও একটু কমবেশি আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাতি নিয়ে তাঁরা ঘুরে বেড়ান। ঈদের পর বরিশালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে হাতি নেওয়ার জন্য এখন পথে রয়েছেন।

মাহুত দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন (২৯) বলেন, ‘পথে পথে থেমে থেমে যাব। দিনে মাত্র ১২ থেকে ১৩ কিলোমিটার যেতে পারি। এর বেশি গেলে হয়রান হতে হবে। দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। এভাবেই সারা দেশেই যাওয়া পড়ে। হোটেলে খাই, রাস্তায় ঘুরি, পথে ঘুমাই। মানুষ আবার বলে রাস্তায় চাঁদাবাজি করি। মানুষ তো সব এক রকম না, কী বলেন ভাই?’—প্রশ্ন রাখেন আনোয়ার।

এদিকে হাতির খোরাক মেলানো কষ্ট। অন্য খাবারের পাশাপাশি প্রতিদিন কম করে ১০-১২টি কলাগাছ লাগে। শহরে থাকলে বড়জোর একটা দুটি গাছ জোগাড় করা যায়। তবে শহরে ফাটা তরমুজ, আখের ছোবড়া, ডাবের খোলা পাওয়ায় কিছুটা খাবার মেলে। আনোয়ার বললেন, ‘আমরা যেমন সারা দিন কত কী খাই কিন্তু ভাত না হলে চলে না। তেমনি কলাগাছ ওদের প্রধান খাবার।’

রাত নামলে এভাবেই তাঁবু টানিয়ে রাতযাপন করেন মাহুতেরা
ছবি: প্রথম আলো

আনোয়ার বয়সে জ্যেষ্ঠ হলেও অভিজ্ঞতায় দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ। তাঁর গ্রামের অন্য মাহুতদের দেখানো পথে এই পেশায় নেমেছেন। তবে সারা বছর এ কাজ করেন না তিনি। কখনো রংমিস্ত্রি, কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী, আবার কখনোবা রিকশা চালান।
আনোয়ার বলেন, ‘ছোটবেলা দুষ্টমির জন্য পড়ালেখা হইনি। তবে সব কাজই পারি। এখন এইটা ভালো লাগছে তাই করছি। আমাকে যে এটাই করতে হবে, এটাই পেশা এ রকম না। তবে এই জীবন ভালো লাগে। আজ এখানে থাকলাম, কাল ওখানে থাকলাম। নানা রকম জায়গা, নানান মানুষ, নানান দেখার বিষয়, জিনিসটা তো ভালোই।’

কাজ ভালো লাগলেও হতাশা আছে। আনোয়ার বললেন, ‘বাড়ির কথা মনে পড়ে। একটা ৯ বছরের মেয়ে আছে। এরপরও ভাবি, বাংলাদেশে তো আছি বিদেশ তো যায় নাই। মাসে একবার বাড়ি যাই। তবে ছুটি নেওয়ার ঝামেলা আছে। এখনই বাড়ি যাব মনে করলেন আর হয়ে গেল এ রকম শক্তি নেই। মালিককে আগাম জানাতে হয়। অন্য লোক না আসা পর্যন্ত, এসে সেটেল না হওয়া পর্যন্ত আপনি বাড়ি যেতে পারবেন না।’
একটা হাতির পেছনে চারজন লাগে কেন—এসন প্রশ্নে এবার উত্তর দেন আরিফুল। ‘সারাক্ষণ তো পিঠে চড়ে থাকতে পারা যায় না। কোমর লেগে আসে। তিনজন ভাগ করে পিঠে চড়ার কাজ করি। আর একজন পথ দেখাবে, কোনটা ভালো পথ, কোথা দিয়ে যাওয়া যায়।’

পাশ থেকে আবার আনোয়ার বললেন, বড় রোডে যাওয়া কঠিন। পুলিশে ঝামেলা করে। কাগজপত্র দেখাতে হয়। চিড়িয়াখানা থেকে চুরি করেছেন কি না, কোথায় যাবেন, চাঁদাবাজি করেন কেন—এ রকম নানা প্রশ্ন। এ জন্য ভেতরের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকে।

মাহুত দলের প্রধান সবুজ। মাসখানেক হলো তিনি হাতিটির সঙ্গে আছেন
ছবি: প্রথম আলো

দলের দলপতি সবুজ (২৪) খুব ছোটবেলাতেই হাতি চালানো শিখেছেন। তবে হাতে ভালো বিকল্প থাকলে তিনি মাহুতগিরি করেন না। এই পেশা এখন আর ভালো লাগে না। তাঁর কাছে পেশাটা মর্যাদার না। গ্রামের খেতে কাজ করতেন, এখন কাজ নেই তাই মাসখানেক হাতিটির সঙ্গে আছেন।

সবুজ বলেন, শখ ছিল, শিখেছেন। এটা এখন ভালো লাগে না। কোনো ধরনের নিশ্চয়তা নেই। শহরে রাতে হাতি রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। কোথায় থাকবের এটাই ঠিক করা যায় না। পথেঘাটে থাকতে হয়। যাযাবরের জীবন। বাড়িতে এক দিল না খেয়ে থাকলেও শান্তি। পথেঘাটে থাকাটা একটা অশান্তি।

সবাই কথা বললেও নাম বলা ছাড়া কোনো কথা বললেন না জৈন্তাপুরের সবুজ। সবার সঙ্গে যোগ দিলেন তাঁবু গোটানোয়। প্রতি রাতে তাঁবু পাততে হয়। প্রতিদিন সকালে খুলতে হয়। এরপর কাঁথা-কাপড়, তাঁবু সুন্দর করে ভাঁজ করে বস্তায় ঢুকিয়ে হাতির পিঠে উঠিয়ে দেন।

মাঠ থেকে বের হওয়া সময় আরিফুল যেন দার্শনিক বনে গেলেন। একগাল হেসে বললেন, ‘ভাই সবকিছু ভাঙাগড়ার ব্যাপার; আর টাকার জ্বালা সবচেয়ে বড় জ্বালা।’