হামলার ভয়ে ঝিনাইদহে পাঁচ শতাধিক মানুষ ঘরছাড়া

হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর ও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঝিনাইদহের হরিশংকরপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ঝিনাইদহে প্রতিপক্ষের হামলা ও সহিংসতার ভয়ে পাঁচ শতাধিক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ঘরছাড়া। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় হতাহতের ঘটনায় এসব মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ঝিনাইদহের হরিশংকরপুর ইউনিয়নের চার শতাধিক মানুষ দীর্ঘ ১৮ মাস থেকে ও শৈলকুপা উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের শতাধিক মানুষ চার মাস ধরে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারছে না বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হরিশংকরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম ও সাবেক চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে। গত বছরের ৪ জুন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হরিশংকরপুর গ্রামে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন আলাপ শেখ ও নুর ইসলাম। তাঁরা খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদের সমর্থক ছিলেন।

এ ঘটনায় বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুমসহ ২৫ জনের নামে হত্যা মামলা করেন নিহত আলাপ শেখের ভাই গোলাপ শেখ। আসামিরা বর্তমানে জামিনে আছেন। ওই ঘটনার পর বেশ কিছু বাড়িঘর ভাঙচুর ও কয়েক কোটি টাকার মাল লুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক বাড়ি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিপক্ষের হামলা ও সহিংসতার ভয়ে ইউনিয়নের চার শতাধিক নারী-পুরুষ গ্রামছাড়া।

হরিশংকরপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম দাবি করেন, সহিংসতার সময় তিনি উপজেলা পরিষদের একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন। আরও অনেকে ঘটনার সময় এলাকাতেই ছিলেন না, তারপরও আসামি করা হয়েছে। তাঁকে আসন্ন নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে মামলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত বা আসামি নন এমন অনেকের বাড়িও লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ভোটের সময় ভোটাররা আনন্দ করবেন, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। গ্রামছাড়া থাকলে সেটা হবে না, এতে নিরপেক্ষ ভোট নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে।

সম্প্রতি সরেজমিনে হরিশংকরপুর ইউনিয়নে দেখা যায়, গ্রামের বেশ কিছু ভাঙা বাড়ি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। অনেক ফাঁকা বাড়ি হয়ে পড়েছে জঙ্গলাকীর্ণ। বেশ কিছু বাড়িতে কোনো মানুষ দেখা যায়নি, ভিটেমাটিতে সুনসান নীরবতা। মুঠোফোনে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা বিল্লাল হোসেনের স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, সহিংসতার ঘটনার আগে থেকেই তাঁর স্বামী বিদেশে আছেন। তাঁর ছেলে রাব্বি (১৭) ও মেয়ে ইলমাকে (৯) নিয়ে বাড়িতে বসবাস করতেন। তাঁর সেই বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁরা শহরে ভাড়া বাসায় থাকেন, তাঁদের গ্রামে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।

গ্রামের অপর বাসিন্দা শফিকুল আলমের স্ত্রী ফারজানা কবির বলেন, তাঁর স্বামী চার বছর ধরে বিদেশে। তাঁর বাড়িটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ বলেন, তাঁর প্রতিপক্ষ বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাসুম এই হত্যাকাণ্ডের ইন্ধনদাতা, যে কারণে তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

এদিকে শৈলকুপা উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা আরিফ রেজা এবং উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলামের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বের জেরে গত ২৫ জুলাই হামলায় নিহত হয়েছেন মনোহরপুর ইউনিয়নের দামুকদিয়া গ্রামের রাশিদুল আলম মৃধা। এ ঘটনায় ২৮ জনকে আসামি করে শৈলকুপা থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত রাশিদুলের স্ত্রী। মামলার ২১ জন জামিনে আর ৭ জন কারাগারে আছেন। এই ঘটনার পর এলাকায় বেশ কিছু বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রতিপক্ষের হামলায় শতাধিক মানুষ গ্রামছাড়া।


ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলামের দাবি, তিনি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীক চাওয়ায় তাঁকেও মামলার আসামি করা হয়েছে। ঘটনার সময় তিনি থানায় ছিলেন। এখন তাঁর সমর্থকদের বাড়ি যেতে দেওয়া হচ্ছে না। শতাধিক মানুষ বাড়িছাড়া।

নিহত রাশিদুলের ছোট ভাই নাজির উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ঘটনার এক দিন আগে জাহিদুল ইসলাম তাঁর ভাইকে হুমকি দেন। দূর থেকে তিনি ঘটনার ইন্ধন দেওয়ায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। গ্রামছাড়া মানুষের বিষয়ে তিনি বলেন, তিন থেকে চারটি পরিবারের সদস্যরা বাড়িছাড়া আছে।

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হাকিম বলেন, তাঁরা শৈলকুপার দামুকদিয়ার বাড়িছাড়া মানুষকে বাড়ি ফেরাতে ইতিমধ্যে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন। আশা করছেন, অচিরেই তারা বাড়ি ফিরতে পারবে। আর হরিশংকরপুরের বিষয়ে দ্রুতই আলোচনা করবেন।

ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, বাড়িছাড়া মানুষদের কয়েক দফা বাড়ি ফিরতে বলেছেন। কিন্তু তারা ভয়ে বাড়ি ফিরছে না। ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিচার হবে, কিন্তু বাড়িছাড়া করা হবে, এটা হতে পারে না। দ্রুতই তারা যাতে বাড়ি ফিরতে পারে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।