কিশোরগঞ্জের হাওরের বিস্তৃত জলরাশি এখন যেন ‘মৃত্যুর দরিয়া’য় পরিণত হয়েছে। এখানকার পানিতে গোসল করতে নেমে স্থানীয় অনেক শিশু মারা যাচ্ছে। আবার হাওরের নয়নকাড়া সৌন্দর্যের টানে ছুটে এসে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক পর্যটক। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানায় বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা যায়, বর্ষায় হাওরে নতুন পানি আসার পর থেকে গত তিন মাসে শিশু, পর্যটকসহ অর্ধশতাধিক মানুষ মারা গেছে। গত জুলাইয়ের শুরু থেকে দেড় মাসে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৬ জন। প্রশাসনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও হাওরে পর্যটকদের ছুটে আসা থামছে না। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানার কারণে মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা আল আমিনসহ কয়েকজন বলেন, কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীতে বেড়িবাঁধসহ কয়েকটি সেতু ও সড়ক রয়েছে। রয়েছে ডুবোসড়ক। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এসব স্থানের সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে। এসবই তাঁদের টেনে আনছে হাওরে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, অনেক পর্যটক হাওর দেখার পাশাপাশি ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার ও গোসলে নামেন। অনেকে নৌকায় দল বেঁধে ঘুরতে বের হন। এ সময় অনেকে নিরাপত্তার কথা ভুলে যান। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানার কারণে সৌন্দর্য দেখতে এসে লাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। যদি পর্যটকেরা সতর্ক থাকেন, তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে।
১৫ আগস্ট মিঠামইন উপজেলার শরীফপুর এলাকায় হাওর থেকে সালেহা আক্তার (৬৫) নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আগের দিন সালেহাসহ আটজন করিমগঞ্জের চামড়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকায় যাত্রা করলে সেটি প্রবল বাতাসের কবলে পড়ে ডুবে যায়। অন্য যাত্রীরা সাঁতরে পাশের জেলে নৌকায় উঠে রক্ষা পেলেও নিখোঁজ হন সালেহা। এর আগে ১১ আগস্ট সকালে নিকলী উপজেলার শহরমূলে মামার বাড়িতে গিয়ে হাওরের পানিতে ডুবে যায় শোলাকিয়া এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে তাসনিমুর রহমান (১৩)। ঘণ্টাখানেক পর তার লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন হাওর থেকে আরও তিন শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা হলো ভৈরব পৌর শহরের কালিপুর গ্রামের খোকন মিয়ার মেয়ে পাপিয়া খাতুন (৭), বধূনগর গ্রামের আরিজ মিয়ার দেড় বছর বয়সী ছেলে আলভীন মিয়া ও পাকুন্দিয়া উপজেলার বাহাদিয়া মুন্সিবাড়ি গ্রামের দ্বীন ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ আল ফাহাদ (১১)।
তাসনিমুরের বাবা মতিউর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এমন কষ্ট যেন কোনো বাবার সইতে না হয়।
২ আগস্ট ইটনার মাগুরী এলাকায় ধনু নদে যাত্রীবাহী নৌকা ডুবে নববধূসহ তিনজন মারা যান। তাঁরা হলেন মাওরা গ্রামের বরজু মিয়ার মেয়ে হীরামনি (৫), মো. মোখলেছ মিয়ার নববিবাহিত স্ত্রী সুমাইয়া (১৮) ও মাঝি হাসান আলী (৭০)। ৪ আগস্ট নিকলীর হাওরে গোসল করতে নেমে ডুবে জান্নাত আরা বাবুনী (৬) নামে একটি শিশু মারা যায়। একই দিন নিকলীর হাওরে ঘুরতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই তরুণের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও তিনজন। মৃত তিনজন হলেন গুরুই পূর্বপাড়া এলাকার গোলাপ মিয়ার ছেলে অন্তর মিয়া (২০) ও আসিদ মিয়ার ছেলে মনির মিয়া (১৮)।
স্থানীয় লোকজন জানান, ৪ আগস্ট বিকেলে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে হাওরে ঘুরতে যায় তরুণদের একটি দল। একপর্যায়ে হাওরে পল্লী বিদ্যুতের একটি তারে নৌকাটি আটকে যায়। নৌকার ওপরে থাকা মনির তারটি উঁচু করার চেষ্টা করলে নৌকা বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। এতে মনির ও অন্তর ঘটনাস্থলেই মারা যান।
৬ আগস্ট ভৈরবে নদীতে গোসল করতে নেমে মাহমুদুল ইসলাম (১৮) নামে একজন মারা যান। ৮ আগস্ট করিমগঞ্জের হাসানপুর সেতু এলাকায় হাওরে গোসল করতে নেমে হাদিউল ইসলাম (৩২) ও ইকরামুল ইসলাম (২০) নামের দুজনের মৃত্যু হয়। হাদিউল টাঙ্গাইলের সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। ইকরামুল কটিয়াদীর দক্ষিণ চরপুখিয়া গ্রামের বাসিন্দা।
২ জুলাই ইটনা উপজেলায় হাওরের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো ভয়রা নয়াহাটি গ্রামের বাতেন মিয়ার ছেলে সানজিদ মিয়া (২) ও বড়হাটি গ্রামের সুজিত ঘোষের ছেলে সুগ্রীব ঘোষ (৬)। ১১ জুলাই নিকলীর মোহরকোনা বেড়িবাঁধ এলাকায় হাওরে ঘুরতে গিয়ে পানিতে ডুবে মেহেদি হাসান (১৬) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়। সে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ভানুয়া গ্রামের মুজিবুর রহমানের ছেলে। পরদিন মো. হাসান নামে এক পর্যটক নিকলীর হাওরের পানিতে ডুবে মারা যান। ২৩ জুলাই ভৈরবের জগন্নাথপুরে পানিতে ডুবে লামিয়া (৬) ও প্রিয়া (৩) নামে দুই বোনের মৃত্যু হয়।
স্থানীয় লোকজন আরও জানান, গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে হাওরে বেড়াতে এসে করিমগঞ্জের হাসানপুর সেতু-সংলগ্ন এলাকায় গোসল করতে নামা দুই পর্যটকসহ তিন মাসে অর্ধশতাধিক লোক মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, বর্ষায় কিশোরগঞ্জের হাওর ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এবার শুরু থেকেই করোনার কারণে কড়াকড়ি নজরদারি করা হচ্ছে। তবু পর্যটন এলাকায় সাঁতার না জানা সত্ত্বেও পানিতে নামায় কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। সেটা খুবই দুঃখজনক। তবে যেসব জায়গা বিপজ্জনক, সেসব জায়গায় সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে নজরদারি জোরদার করা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি আগে বিবেচনা করতে হবে।