হাওরে স্বস্তির রোদ, চলছে ধান কাটার ধুম
হাওরে যেন ফিরেছে বৈশাখের চিরচেনা রূপ। টানা কয়েক দিন রোদ অব্যাহত থাকায় কৃষকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। হাওরের প্রায় সব বয়সী মানুষ এখন ধান কাটায় ব্যস্ত। একই সঙ্গে চলছে ধানমাড়াই, শুকানো ও গোলায় তোলার কাজ। ফসল হারানোর ভয় কাটিয়ে বেশির ভাগ কৃষকের মুখে এখন সোনালি হাসি দেখা যাচ্ছে।
তবে সুনামগঞ্জের কোনো কোনো হাওরপাড়ের মানুষের ফসল হারানোর করুণ গল্প আছে। গতকাল রোববার পর্যন্ত উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে এবার জেলায় বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে ২০টি ছোট-বড় হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। অনেক কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাঁদের পরিবারের নতুন ফসলের আনন্দ নেই, বরং আছে ফসল হারানোর কষ্ট।
হাওরের প্রায় সব কটি ফসল রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে থাকায় ফসল নিয়ে সব কৃষকেরই শঙ্কা ছিল। এখনো কোনো কোনো বাঁধ ঝুঁকিতে আছে। তবে কয়েক দিন ধরে টানা রোদে জেলার নদ-নদী ও হাওরে পানি কমেছে। এতে ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে গেছে। রোদ থাকায় কৃষকেরা এখন একই সঙ্গে ধান কেটে মাড়াই ও শুকানোর কাজটি সেরে ফেলছেন।
পুরো বৈশাখ মাস হাওরে এই ধান তোলার উৎসবকে ‘বৈশাখী’ বলেন স্থানীয় লোকজন। ধান তোলার জন্য অনেকেই এখন হাওরে রাত কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
আজ সোমবার দুপুরে উপজেলার দেখার হাওরপাড়ের ইসলামপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় কৃষক মো. গোলাম মস্তফার (৫৩) সঙ্গে। তিনি হাওরে ১০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। এর মধ্যে সাত বিঘার ফসল কেটেছেন। সেগুলো মাড়াই ও শুকনোর কাজ চলছে। তিন দিনের মধ্যে সব ধান গোলায় তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
চনমনে রোদে মাড়াই করা ধান থেকে কুলা দিয়ে ছিটা ছাড়াচ্ছিলেন গোলাম মস্তফার স্ত্রী আয়েশা খাতুন (৪৭)। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন নারী। আয়েশা বেগম বলেন, ‘বৈশাখী তুলতে আমরার কোনো কষ্ট নাই, ইটা আমরার লাগি আনন্দের। ঘরের সবাই ধান তুলার কাম করে।’
জেলার শাল্লা উপজেলা থেকে রোববার বিকেলে দিরাই ফেরার পথে রাস্তার দুই পাশে ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর বহু দৃশ্য দেখা গেছে। কোথাও খলায়, আবার কোথাও রাস্তাজুড়েই ছিল ধান আর ধান। ধানের ম-ম গন্ধ ছিল চারদিকে। নারীরাই ধান শুকানোর কাজ করেন। পুরুষদের কাজ হলো ধান কেটে আনা ও মাড়াই করা। এসব কাজে আনন্দে ঘরের শিশুরাও যোগ দেয়।
ধানের খলায় একধরনের উৎসব উৎসব ভাব থাকে। এখানে খাওয়াদাওয়া চলে। খলাতেই ছোট করে তৈরি করা হয় বিশ্রামের ঘর। পুরো বৈশাখ মাস হাওরে এই ধান তোলার উৎসবকে ‘বৈশাখী’ বলেন স্থানীয় লোকজন। ধান তোলার জন্য অনেকেই এখন হাওরে রাত কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
শাল্লার কাশিপুর গ্রামের জগদীশ দাশ বলেন, ‘এই বার যে অবস্থা তৈরি অইছিল, তাতে মনে করছিলাম কোনো ধানই পাইতাম না। যাহোক, শেষমেশ ধান তুলতাম পারছি, এতেই খুশি।’
খলায় পা দিয়ে ধান নাড়তে নাড়তে জগদীশের স্ত্রী প্রতিভা দাস বলেন, ‘ ধানই আমরার সব। এই ধানেই দিন যায়। ধান না পাইলে তো না খাইয়া থাকতে অয়। যারার ধান গেছে (নষ্ট হয়েছে), তারা এই কষ্ট বুঝব।’
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই মৌসুমে সুনামগঞ্জের ১৩৭টি হাওর ও বিলে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর বোরো আবাদ হয়েছে। জেলায় সোমবার সকাল পর্যন্ত ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭২ হেক্টর ধান কাটা হয়েছে, যা মোট ধানের ৬৪ শতাংশ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতি ভালো থাকায় সুবিধা হচ্ছে। শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে ৫৯২টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১০৮টি রিপার কাজ করছে। যে কারণে দ্রুত ধান কাটা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেছেন, পানি সামান্য কমছে। তবে হাওরের বাঁধগুলোতে ২৫ দিন ধরে পানি চাপ আছে। এ জন্য মাটি নরম হয়ে আছে। অনেক স্থানে ফাটল, ধস আছে। তাই কোনো বাঁধই ঝুঁকির বাইরে নয়। তবে বৃষ্টি হচ্ছে না, এটা কৃষকদের জন্য ভালো খবর।
সুনামগঞ্জে এবার প্রথম দফা পাহাড়ি ঢল আসে ৩০ মার্চ। এতে জেলার নদ-নদী ও হাওরে ব্যাপক পরিমাণে পানি বৃদ্ধি পায়। এ সময় জেলার সব হাওরের বোরো ধান ঝুঁকিতে পড়ে। এরপর একে একে ২০টি ছোট-বড় হাওর তলিয়েছে। প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকদের দাবি, ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।