হবিগঞ্জে পুকুর ভরাট করে শপিং মল নির্মাণের উদ্যোগ
হবিগঞ্জ শহরের মধ্যে যে কয়েকটি পুকুর বড় ছিল, তার মধ্যে টাউন মডেল পুকুর অন্যতম। অথচ গত দুই দশকে এ পুকুরের প্রায় অর্ধেক জায়গা ভরাট করে ট্রাকস্ট্যান্ড করা হয়েছে। এখন শপিং মল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
হবিগঞ্জ পৌর ভবনের পাশে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিপরীতে টাউন মডেল পুকুরের অবস্থান। শহরের মধ্যে যে কয়েকটি পুকুর বড় ছিল, তার মধ্যে এটি একটি। অথচ গত দুই দশকের ব্যবধানে এ পুকুরের প্রায় অর্ধেক জায়গা ভরাট করে ট্রাকস্ট্যান্ড এবং পুকুরের তিন পাশ ঘিরে টিনের ছাউনির অসংখ্য দোকানপাট তৈরি হয়েছে। তবে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো ভূমিকাই পালন করেনি।
সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান পৌর কর্তৃপক্ষ পুকুরটি পুরোপুরি ভরাট করে একটি শপিং মল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। কিছুদিন আগে ঘোষিত পৌর বাজেটেও এর জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে চলতি বছরের ৫ জুলাই বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার নেতারা পৌর মেয়র মো. মিজানুর রহমানের কাছে লিখিত আবেদনে এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পুকুরের অর্ধেকের বেশি অংশ দখল করে নির্মিত ট্রাকস্ট্যান্ডে ১৪টি ট্রাক ও ২টি পিকআপ পার্কিং করে রাখা হয়েছে। এর বাইরে পুকুরের তিন দিক ঘিরে টিনের তৈরি অর্ধশতাধিকের বেশি দোকানপাট রয়েছে। এসব স্থানে রেস্তোরাঁ, সেলুন, জুতা, কাপড়ের দোকানসহ নানা পসরার দোকান রয়েছে। তবে এখনো পুকুরের কিছু অংশের অস্তিত্ব টিকে আছে। কিন্তু সেখানে আগের মতো পানি নেই। টিকে থাকা পুকুরের ওই অংশে কচুগাছ ও ঘন ঝোপ দেখা দিয়েছে।
বাপা হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, তাঁরা লিখিতভাবে পুকুরে শপিং মল স্থাপনের জন্য আর্থিক বরাদ্দ ঘোষণার বিষয়টি বাতিলের জন্য মেয়রের কাছে আবেদন করেছেন। এ ছাড়া পুকুর থেকে সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ, ট্রাকস্ট্যান্ড অপসারণ এবং সুবিবেচিত নকশা প্রণয়ন করে পুকুরকে দৃষ্টিনন্দন করার উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোনোভাবেই পৌর কর্তৃপক্ষ পুকুর ভরাট করতে পারে না।
দুই দশক আগেও পুকুরটিতে স্থানীয় অধিবাসীরা গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালির প্রায় সব কাজ করতেন। ২০০০ সালের পর বেশ কয়েকজন হকার এখানে পসরা নিয়ে বসতে শুরু করেন। এরপর পুকুরটির তিন পাড়ে টিনের ছাউনির স্থায়ী দোকানপাট তৈরি করে ধীরে ধীরে দখল করা হয়।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, দুই দশক আগেও পুকুরটিতে স্থানীয় অধিবাসীরা গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালির প্রায় সব কাজ করতেন। এটি শহরের অন্যতম গভীর পুকুর ছিল। ২০০০ সালের পর বেশ কয়েকজন হকার এখানে পসরা নিয়ে বসতে শুরু করেন। এরপর নানা কায়দায় পুকুরটির তিন পাড়ে টিনের ছাউনির স্থায়ী দোকানপাট তৈরি করে ধীরে ধীরে দখল করা হয়।
একই সূত্রে জানা গেছে, সে সময়ই পুরোনো বাসস্ট্যান্ডে বাস যাওয়ার সুবিধার্থে পুকুরের একাংশ দখল করে একটি আড়াআড়ি রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এর কিছুদিন পরই পুকুরের ঠিক অর্ধেক জায়গা দখল করে ট্রাকশ্রমিকেরা অস্থায়ীভাবে তাঁদের ট্রাক রাখতে শুরু করেন। পৌর কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে তাঁদের মালিকানাধীন পুকুরে এমন প্রক্রিয়া চললেও তা উচ্ছেদে কোনো ভূমিকাই রাখা হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
পুকুরের পাশের শায়েস্তানগর এলাকার বাসিন্দা এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জহিরুল হক বলেন, দুই দশক আগেও শহরের প্রবেশদ্বারে দৃষ্টিনন্দন ছিল পুকুরটি। পুকুরের তিন পাড়ের লোকজন অর্থাৎ শায়েস্তানগর, মোহনপুর ও ঘোষপাড়া এলাকার বাসিন্দারা এবং পাশের বাসস্ট্যান্ডের পরিবহনশ্রমিকেরা এখানে গোসল করতেন। পুকুরপাড়ে অবস্থিত দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাঁতার প্রতিযোগিতাও হতো এখানে। পানির আধারের পাশাপাশি এখানে মাছের চাষও হতো।
জহিরুল হক আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী ফায়ার সার্ভিসের জরুরি টেন্ডার ট্রাকে পানিও ভর্তি করানো হতো এই পুকুর থেকে। হকারদের দোকানপাট তৈরির পাশাপাশি পুকুরের পাশের পুরোনো বাসস্ট্যান্ডে বাস প্রবেশের জন্য আড়াআড়ি করে একমুখী একটা রাস্তা নির্মাণ করায় পুকুরটি সংকীর্ণ হয়ে যায়। পরে ধীরে ধীরে বাকি অর্ধেক ভরাট করা হয়। এখন এটি দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এখানে একসময় দৃষ্টিনন্দন একটি পুকুর ছিল।
শহরের পরিবেশকর্মী ও সচেতন মানুষেরা বলেন, এখনো পুরো পুকুরটি আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় আছে। এখানে শপিং মল নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে পৌর কর্তৃপক্ষকে সরে আসতে হবে। কীভাবে পুকুরটিকে পুনরায় আগের অবস্থায় নিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তা পরিবেশ ও প্রতিবেশের স্বার্থেই ভাবতে হবে।
হবিগঞ্জ পৌরসভার বাজার পরিদর্শক গোলাম কিবরিয়া জানান, হকাররা পুকুরের জায়গা দখল করে দোকানপাট তৈরি করেছিল। ট্রাকশ্রমিকেরাও নিজ উদ্যোগে পুকুরের একটি অংশে ট্রাক রাখছেন। এখানে পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই।
পুকুরটি আগেই ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখানে একটি শপিং মল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন সচেতন মানুষেরা যদি পুকুর ভরাট করে শপিং মল নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি জানান, তবে পৌর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে।
পৌর মেয়র মো. মিজানুর রহমান গত সোমবার রাতে তাঁর বাসভবনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছরখানেক আগে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আমি বিজয়ী হয়ে মেয়র হয়েছি। এর অনেক আগেই পুকুরের চারপাশে দোকানপাট ও ট্রাক রাখার অস্থায়ী জায়গা তৈরি হয়েছিল। পুকুরটি আগেই ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখানে একটি শপিং মল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে অবশ্যই পুকুর থেকে স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এখন সচেতন মানুষেরা যদি পুকুর ভরাট করে শপিং মল নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি জানান, তবে পৌর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে। এ ছাড়া পুকুরকে ঘিরে দৃষ্টিনন্দন ও সৌন্দর্যবর্ধক কিছু করা যায় কি না, সেটাও ভেবে দেখা হবে।’