স্নাতকোত্তর যখন ভিন্ন বিষয়ে
প্রাণরসায়নে স্নাতক (সম্মান) করেছিলেন তুহিন বিশ্বাস। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই আগ্রহ জন্মায় মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ অনুসন্ধান এবং এর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে। তাই স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হন জনস্বাস্থ্য (পাবলিক হেলথ) বিষয়ে। পাস করার পর এখন জনস্বাস্থ্যই তাঁর কাজের ক্ষেত্র।
তুহিন বিশ্বাসের মতো হাজারো শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা ভিন্ন ক্যারিয়ার গড়ছেন। স্নাতক পর্যায়ের পঠিত বিষয়ের ওপর ক্যারিয়ার গড়তে হবে, এই ধারণা পাল্টে গেছে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের পাশাপাশি চাকরির বাজার ও পেশাগত উন্নতির সুযোগের কারণে এই পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতে, পেশা নির্বাচনের ধারণাটা এখনকার পৃথিবীতে একটু ভিন্ন। যুগের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, বিভিন্ন পেশার চাহিদা। স্নাতকের পর পেশা বদলের সিদ্ধান্ত নিলে সেই ক্ষেত্রে খোলা আছে অন্য অনেক বিষয়ে মাস্টার্স, ডিপ্লোমা কিংবা দক্ষতা অর্জনের শর্ট কোর্স। চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ রকম বিষয়ে পড়ার সুযোগ দিচ্ছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী এমবিএ বা ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পেছনে ছুটছেন। প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বা মৌলিক বিজ্ঞান থেকে স্নাতক করে অনেকেই এখন এমবিএতে পড়াশোনা করছেন। কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যাংক, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বা উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে।
তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের কারণে আউটসোর্সিং হয়ে উঠেছে তরুণদের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। যদি ওয়েব পেজ ডিজাইনিং, গ্রাফিকস ডিজাইন, ডেটা এন্ট্রি, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট—এই ধরনের কাজগুলো জানা থাকলে তাহলে ঘরে বসেই দেশ-বিদেশের নানা কাজের অর্ডার পাওয়া যাবে। নৃবিজ্ঞানের কিংবা উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্রও এই কাজগুলো করতে পারেন। দরকার শুধু কাজের জ্ঞান ও দক্ষতা।
জীবপ্রযুক্তিবিদ থেকে ফ্রিল্যান্সার
ইভান আহমেদ। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবপ্রযুক্তিতে। কিন্তু বরাবরই তাঁর আগ্রহের জায়গা ছিল তথ্যপ্রযুক্তি। তাই শিখেছেন ট্রান্সক্রিপশন, ক্রিয়েটিভ রাইটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ। এখন ঘরে বসেই অর্থ উপার্জন করছেন তিনি। দক্ষতা অর্জন করতে নিয়েছেন বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ।
ইভান আহমেদ বলেন, প্রোগ্রামিং, ওয়েব পেজ ডিজাইনিং–এর মতো ব্যাপারগুলো এখন শেখা যায় বেসিস পরিচালিত বিআইটিএমসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। আউটসোর্সিং করতে হলে ইংরেজির দক্ষতা থাকাটা খুব জরুরি।
প্রাণরসায়ন থেকে জনস্বাস্থ্য
দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা। পুরো পৃথিবীতেই এখন শুধু চিকিৎসাব্যবস্থাকে এককভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তার আগে নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্বাস্থ্য সমস্যা, তার কারণ অনুসন্ধান ও উত্তরণের উপায় নিয়ে কাজ হচ্ছে। এই সম্পর্কে পড়ারও সুযোগ রয়েছে।
পাবলিক হেলথ বা এমপিএইচ করে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে কাজ করার সুযোগ। চিকিৎসক, অণুজীববিজ্ঞানী, প্রাণরসায়নবিদ, জীবপ্রযুক্তিবিদ, জিন প্রকৌশলী, পরিসংখ্যানবিদ, সমাজবিজ্ঞানী—এ রকম পেশার যে কেউ এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পারেন।
প্রাণরসায়নে স্নাতক করে জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর করা তুহিন বিশ্বাস বলেন, ‘অনার্সে পড়ার সময় যতই ওপরের দিকের সেমিস্টারগুলোতে যাচ্ছিলাম ততই মনে হচ্ছিল এ পড়াশোনা ভালো লাগছে না। রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে কাজ করার চেয়ে মানুষের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ অনুসন্ধান এবং তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণে আমার আগ্রহ বেশি। আর তাই আমি জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তরের ডিগ্রি নিই। এখন এ বিষয় নিয়েই কাজ করছি।’
পুরকৌশলবিদ্যা থেকে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
এ সময়ের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ। উন্নয়ন-সংক্রান্ত গবেষণা কিংবা তথ্য–উপাত্ত নিয়ে কাজ করার একটি বিশাল ক্ষেত্র। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে রয়েছে মাস্টার্স করার সুযোগ। প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থী ঝুঁকছেন এই বিষয়ে।
অনন্যা রুবাইয়াত এ বিষয়ে সফলদের একজন। ছিলেন পুরকৌশলের ছাত্রী। স্নাতকও করেছিলেন ওই বিষয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ওপর। ক্যারিয়ারও গড়েছেন ওই বিষয়ে। এখন কাজ করছেন বিভিন্ন জরিপ ও তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানে।
এসব বিষয় ছাড়াও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ আছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। যাঁরা লাইব্রেরি-সংক্রান্ত পেশায় জড়িত হতে চান তাঁদের জন্য এটা একটা পছন্দের জায়গা হতে পারে। দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া যায় প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। দেশের বাইরে ব্যাপক চাহিদা এই বিষয়ের পেশাজীবীদের। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পোর্টসিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ। যোগ্যতা থাকলে এই বিভাগে ডিগ্রি নিয়ে গড়া যাবে ক্যারিয়ার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক আদনান মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, নিজের বিষয়ে চাকরি না পেলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। নিজের পছন্দ এবং সক্ষমতা অনুযায়ী অন্য যেকোনো পেশা বেছে নেওয়া যায়। দুয়ার এখন উন্মুক্ত। স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষে নিজেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন পথে হাঁটবে।