চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে গত শনিবার রাতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন যে যেভাবে পেরেছেন, উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউ কেউ নিজের জীবনের পরোয়া না করে ঘটনাস্থল থেকে লোকজনকে উদ্ধার করেছেন। কেউ দগ্ধ ব্যক্তিদের পুকুরের পাড়ে নিয়ে পানি ঢেলে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনার ভয়াবহতা জানিয়ে গাড়িচালকদের থামিয়েছেন, গাড়িতে করে আহত ব্যক্তিদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার কারখানা এলাকায় ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র ওঠে এসেছে। কে কতজনকে উদ্ধার করে হাসপাতাল পর্যন্ত পাঠিয়েছেন, তার হিসাব তাঁরা রাখেননি। তবে অনেকেই বলছেন, স্থানীয় একজন চা–বিক্রেতা হানিফ, মই দিয়ে কাঁটাতারের দেয়াল টপকে অন্তত ৩০ জনকে উদ্ধারে সহায়তা করেছেন।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ডিপোর দক্ষিণ দিকের পকেট গেটটি খোলা থাকলে হতাহত ব্যক্তির সংখ্যা আরও কম হতে পারত। অনেকে এখান দিয়ে বের হয়ে যেতে পারতেন। তা ছাড়া এদিকের দেয়ালের ওপর কাঁটাতার থাকায় দেয়াল টপকে লোকজন বের হতে পারছিলেন না। বেশির ভাগ মানুষকে পূর্ব দিকের দেয়ালের অংশ দিয়ে বের করে আনতে হয়েছে। উদ্ধারকাজে তাই সময় বেশি লেগেছে।
গত শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনে রাসায়নিকের কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়ে এখন পর্যন্ত ৪৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।
ডিপোর দক্ষিণ পাশের পকেট গেটের কাছে চা–দোকান হানিফের। তিনি একাই অনেককে উদ্ধারে সহায়তা করেছেন। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের পর আহত ব্যক্তিরা দেয়ালের অপর পাশে আর্তনাদ করছিলেন। তখন তিনি কাঁটাতারের দেয়াল টপকে কীভাবে তাঁদের উদ্ধার করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। কোনোরকমে দেয়ালে উঠে হাত দিয়ে টেনে অন্তত পাঁচজনকে তিনি উদ্ধার করেন। তাঁর স্ত্রী বিস্ফোরণের ঘটনা শুনে তাঁকে খুঁজতে আসেন। তিনি তখন স্ত্রীকে বাড়ি থেকে মই আনতে বলেন। পরে ওই মই দিয়ে বাইরে আসেন আরও ২৫ জনের মতো।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. সোহেলের দাবি, তাঁদের পাড়ার প্রায় সব পুরুষ উদ্ধারকাজে অংশ নেন। কেউ কেউ রাস্তা থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছেন আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে পাঠানোর জন্য। কেউ কেউ আহত ব্যক্তিদের ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। তিনি নিজেও প্রতিবেশীদের নিয়ে কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তুলেছেন।
রমজান আলী নামের একজন বলেন, আহত ব্যক্তিদের সবাই তাঁদের শরীরের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে বলে চিৎকার করছিলেন। তখন তাঁরা কয়েকজন তাঁদের পুকুরঘাটে নিয়ে গায়ে পানি ছিটিয়ে দেন।
জানে আলম নামের একজন বলেন, আগুন থেকে বাঁচতে অনেকে পরনের কাপড় খুলে ফেলেছেন, আবার কারও কারও কাপড় পুড়ে গিয়েছিল। স্থানীয় লোকজন তাঁদের কাপড় এসব লোকজনকে দিয়েছেন। এলাকার যাঁরা গাড়িচালক তাঁরা তাঁদের গাড়িতে করে আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।
ডিপোর দুর্ঘটনাস্থল থেকে দেয়াল টপকে বের হয়ে আসেন নিরাপত্তাপ্রহরী আবদুল সাত্তার। তাঁর পায়ের দুই স্থানে ও হাতে ক্ষত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন তাঁর ডিউটি ছিল না। আগুন লাগার খবর শুনে তিনি সাহায্য করতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণে অন্যদের সঙ্গে তিনিও দৌড় দেন। আগুনের তাপ এত বেশি ছিল যে মনে হয়েছিল শরীরের মাংস সেদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি দৌড়ে দক্ষিণ দিকের ৫২ নম্বর দরজার কাছে আসেন। সেটি দিয়ে পার হতে পারেননি। তখন যান পকেট গেটে। সেটি বন্ধ পাস। তখন আহত ব্যক্তিরা আর্তনাদ করছিলেন। তারপর দৌড়ে পূর্ব পাশের দেয়াল দিয়ে পার হন তিনি। বহু আহত ব্যক্তি ওই দিকের দেয়াল টপকে বের হন।
সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. ইয়াকুব প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় লোকজন যে যেভাবে পারেন, আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে কাজ করেছেন। প্রথম দিকে উদ্ধারকাজে মূল ভূমিকা পালন করেছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা বিস্ফোরণের ভয়ে এগিয়ে না এলে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।