সৈকতে ভাস্কর্য গড়ে ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদ
দুপুর পৌনে ১২টা। বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্ট। সেখানকার উন্মুক্ত সৈকতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল আকৃতির পৃথক দুটি বালুর ভাস্কর্য। সৈকত ভ্রমণে আসা পর্যটকেরা ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানাচ্ছেন বিজয় দিবসের বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।
অন্যদিকে সমুদ্রের পানিতে জাতীয় পতাকা বহন করে দ্রুতগতির ৪৫টি জেডস্কির জলযাত্রা, বালুচরে অর্ধশতাধিক বিচ বাইকের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। আর আকাশে জাতীয় পতাকাবাহী হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ি সৈকতের পরিবেশটাই পাল্টে দিয়েছে। মানুষের চোখে–মুখে বিজয়ের আনন্দ। সবার নজরে সাগরতটে স্থাপিত জাতির জনকের সর্ববৃহৎ বালুর ভাস্কর্য। বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রথম বঙ্গবন্ধুর বালুর ভাস্কর্য এটি। ভাস্কর্যের গায়ে লেখা হয়, ‘সাগরের চেয়ে বিশাল তুমি’।
আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বালুর ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। এ সময় ১০০টি শান্তির প্রতীক পায়রা ওড়ানো হয়। পায়রাগুলো যখন মুক্ত আকাশে উড়ছিল, তখন সৈকতে দাঁড়ানো লোকজনের মুখে মুখে জয় বাংলা ধ্বনি।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে সৈকতে ব্যতিক্রমধর্মী এই বালুর ভাস্কর্যের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন ও ব্র্যান্ডিং কক্সবাজার নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১০ ফুট। এই ভাস্কর্যের পাশে লেখা ‘সাগরের চেয়ে বিশাল তুমি’। এর উত্তর পাশে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বালুর ভাস্কর্য। সেটি ঐতিহাসিক ৭ মার্চকে ঘিরে। ভাস্কর্যের ওপরে লেখা ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দুটি তৈরি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ১৮ জন চারুশিল্পী।
তারও উত্তরে পদ্মা সেতুর আরেকটি বালুর ভাস্কর্য তৈরি করে কক্সবাজার আর্টক্লাব।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাস্কর্য তৈরির গুরুত্ব তুলে ধরেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, কুষ্টিয়ায় জাতির জনকের ভাস্কর্যের প্রতি যে অবমাননা করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে বঙ্গবন্ধুর সর্ববৃহৎ বালুর ভাস্কর্য তৈরি করেছেন কক্সবাজারবাসী। তাঁরা এর মাধ্যমে এই বার্তা দেশবাসীকে দিতে চায়, পৃথিবী যত দিন আছে, তত দিন জাতির জনকের অস্তিত্ব থাকবে।
‘জয় বাংলা’ স্লোগান ধরে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘জাতির জনকের সম্মান আমরা রাখব অম্লান। লাল–সবুজের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। এই ম্যাসেজও বিশ্ববাসীকে জানান দিতেই এই বালুর ভাস্কর্য।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার, পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী, ব্র্যান্ডিং কক্সবাজারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইশতিয়াক আহমদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুশিল্পী দলের নেতা কামরুল হাসান।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দলের নেতা, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আজ সকাল নয়টা থেকেই বালুর ভাস্কর্যের পাশে জড়ো হন ভ্রমণে আসা পর্যটকসহ স্থানীয় নানা শ্রেণি–পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ। উদ্বোধনের পর আশপাশের এলাকায় দর্শনার্থীদের ঢল নামে। বিজয় দিবসের ছুটি কাটাতে এমনিতে সমুদ্রসৈকতে লাখো পর্যটকের সমাগম চলছে। বিকেলে বঙ্গবন্ধুর বালুর ভাস্কর্য এলাকায় লোকসমাগম আরও বেড়ে গেছে। সবাই ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। স্মৃতি ধরে রাখতে কেউ কেউ তুলছেন ছবি, ধারণ করছেন ভিডিও চিত্র।
রাজধানীর বাসাবো থেকে আসা স্কুলশিক্ষক শফিকুর রহমান (৫৫) প্রথম আলোকে বলেন, এই বালুর ভাস্কর্য বিশ্ববাসীকে জানান দিতে পারে, ভাস্কর্যে হামলা কিংবা ভাঙচুর করে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা যাবে না, কারণ, তিনি (বঙ্গবন্ধু) গেঁথে আছেন মানুষের হৃদয়ে। ধর্মান্ধ-মৌলবাদী চক্র দুয়েকটা জায়গায় বঙ্গবন্ধুকে ছোট করে স্বাধীনতার অস্তিত্বকে বিপন্ন করার চক্রান্ত করছে।
সিলেটের হরিপুরের কলেজছাত্রী সালেহা ইয়াসমিন বলেন, বঙ্গবন্ধু না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। বন্ধুবন্ধু মানে লাল–সবুজের পতাকা। একাত্তরের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর ২ লাখ মা–বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলা থেকে এত সহজে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ভাস্কর্য নির্মাণ করে বড় মাপের পরিচয় দিয়েছেন কক্সবাজারবাসী।
ব্র্যান্ডিং কক্সবাজারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইশতিয়াক আহমদ বলেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্রমণে আসা পযর্টকসহ স্থানীয় দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধুর এই বালুর ভাস্কর্য উন্মুক্ত রাখা হবে। এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখবে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে হামলা-ভাঙচুর করে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) সম্মান ক্ষুণ্ন করা যাবে না।