সেচের জন্য বিষ পান করা কৃষকের জমি ফেটে চৌচির, নিয়েছিলেন মহাজনের ঋণ

কৃষক অভিনাথ মারানডির জমি এভাবেই ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। পানি না পেয়ে হতাশ অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম খেতের মাটি ফাটা দেখাচ্ছেন। ছবিটি গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রাম থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষক অভিনাথ মারানডি আগেই তাঁর ধান কম দামে এক মহাজনের কাছে বিক্রি করেছেন। সেই ধানের জমিতে সময়মতো পানি না পেয়ে তিনি বিষ পান করে মারা যান। কিন্তু সেই জমিতে এখনো পানি নেই। ধানের শিষ বের হচ্ছে, এমন সময় তাঁর জমির মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। একই অবস্থা মৃত আরেক কৃষক রবি মারানডির জমিতেও।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত নিমঘটু ও তার পাশের বর্ষাপাড়া গ্রামের সাঁওতাল কৃষকেরা জমির ধান লাগানোর সময় মহাজনের কাছ থেকে টাকা নেন। ধান উঠলে ওই টাকার বদলে মহাজনকে ধান দিতে হয়। এ প্রথা দীর্ঘদিনের। সেটি এখনো চালু আছে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বর্ষাপাড়া গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়। কৃষক আনন্দ টুডু বলন, তাঁর গ্রামে ৫৪টি সাঁওতাল পরিবার আছে। তাদের মধ্যে কমবেশি ৪০টি পরিবারই ধানের ওপর মহাজনের কাছে টাকা নেয়। তিনি বলেন, তিনি ৮০০ টাকা মণ দরে ধান দিতে চেয়ে মহাজনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন।

নরেশ টুডু নামের আরেক কৃষক বলেন, তিনিও ৮০০ টাকা মণ হিসেবে ধান দেওয়ার কথা বলে সাড়ে ৩ হাজার টাকা নিয়েছেন। এটা তাঁদের জন্য নতুন বিষয় নয়। অনেক সময় ধান তুলে মহাজনকে দিতেই সব শেষ হয়ে যায়। ধান তুলে আবার মহাজনের কাছে টাকার জন্য হাত পাততে হয়।

এ ব্যবস্থায় অভিনাথ মারানডি স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে ধান রোপণের সময় ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। বিনিময়ে ধান উঠলে মহাজনকে ৭০০ টাকা মণ হিসেবে ধান দেওয়ার চুক্তি করেছিলেন। অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এই ধানের এখন কী হবে। আর যা হবে তা বিক্রি করে কী করব বুঝতে পারছি না। বড় ছেলেটা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছোটটা এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। এদের পড়াশোনার কী হবে?’

রোজিনা হেমব্রম বলেন, আগে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে কাজ করতেন। এখন তাঁকে একাই সব কাজ করতে হচ্ছে। একজনের রোজগারে সংসারের খরচ জোগাড় করবেন, নাকি ছেলেদের পড়াশোনা করাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

সেচের পানির জন্য বিষ পান করা কৃষক অভিনাথ মারানডির জমি এভাবেই ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ছবিটি গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘটু গ্রাম থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

গোদাগাড়ীতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ভলান্টারি অর্গানাইজেশন (সিসিবিভিও) ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটির সমন্বয়কারী মো. আরিফ বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে তিনি রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটি করে দিয়েছেন। তাঁরা মহাজনের শোষণ থেকে কৃষকদের বাঁচাতে কাজ করেন। অভিনাথ মারানডি তাঁদের নতুন সদস্য। অভিনাথ যে ধানের বিনিময়ে মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, তা তাঁরা পরে জানতে পারেন। তিনি দেড় বিঘা বর্গা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। ধান ভালো না হলে তিনি মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। এ নিয়ে অভিনাথ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। হয়তো সে জন্য ধানের জমিতে সময়মতো সেচের পানি না পেয়ে অভিনাথ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।

গতকাল সন্ধ্যায় নিমঘটু গ্রামে অভিনাথ মারানডির ধানখেতে গিয়ে দেখা গেছে, এক জায়গায় এক বিঘা, আরেক জায়গায় ১০ কাঠা জমিতে অভিনাথের ধান লাগানো আছে। এক বিঘা জমির ধানের অবস্থা খুবই খারাপ। জমিতে যত ধান তত ঘাস। এর মধ্যে ধানের শিষ বের হচ্ছে। খেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। আর ১০ কাঠার প্লটের ধানের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। কিন্তু সেই খেতেও পানি নেই। মাটি শক্ত হয়ে আছে। আর কয়েক দিন পানি না পেলে ওই জমির মাটিও ফেটে যাবে।

রবি মারানডির ধানের অবস্থা আরও খারাপ। ধানের শিষ বের হচ্ছে। এ অবস্থায় তাঁর জমির মাটিও ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।