সুনামগঞ্জে পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে প্রশাসন ও পুলিশের কমিটি

সুনামগঞ্জে আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর উজির মিয়াকে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর পরিবারের লোকজন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে তোলা। গতকাল সোমবার দুপুরে তিনি মারা যান
ছবি: সংগৃহীত

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলায় পুলিশের নির্যাতনে উজির মিয়া (৪০) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুটি কমিটিতেই তিনজন করে সদস্য রয়েছেন। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার উল হালিমকে। পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবু সাঈদ।

আজ মঙ্গলবার দুপুরের পর শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তাঁর লাশ দাফন করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবারের লোকজন ও ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আজ লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হচ্ছে। আমরা ঘটনার তদন্তে কাজ করছি।’

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।

আরও পড়ুন

উজির মিয়াকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের আইনের আওতায় আনার দাবিতে গতকাল সোমবার দুপুরে বিক্ষোভ করেন স্বজন ও এলাকাবাসী। শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলাবাজার এলাকায় সড়কের ওপর লাশ রেখে কয়েক হাজার মানুষ তিন ঘণ্টা সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক অবরোধ করেন। পরে প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত লোকজনকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

জামিনের পর থানা–পুলিশ উজির মিয়ার শারীরিক অবস্থা দেখে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয় এবং চিকিৎসার জন্য পরিবারকে টাকা দিতে চায়। কিন্তু উজির মিয়ার পরিবার সেই টাকা নেয়নি।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, উজির মিয়ার বাড়ি শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্দন গ্রামে। তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। একসময় সৌদি আরবে ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান আছে। মেয়েদের একজনের বয়স আট বছর, অন্যজনের ছয় বছর। এর মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। ৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে বাড়ি থেকে উজির মিয়াকে ধরে নিয়ে যায় শান্তিগঞ্জ থানার পুলিশ। তাঁকে থানায় নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। পরদিন তাঁকে একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। ওই দিনই আদালত থেকে উজির মিয়া জামিনে মুক্ত হন। বাড়িতে আসার পর উজির মিয়ার সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখতে পান পরিবারের সদস্যরা। এরপর উজির মিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পাঁচ দিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে আবার বাড়িতে আনা হয়। সোমবার সকালে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে স্থানীয় কৈতক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের অভিযোগ, শান্তিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান, দেবাশীষ ও পার্ডন কুমার সিংহ উজির মিয়াকে হেফাজতে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করেছেন।

সুনামগঞ্জে পুলিশের নির্যাতনে এক ব্যক্তির মৃত্যুর অভিযোগে লাশ নিয়ে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক অবরোধ। সোমবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

উজির মিয়ার চাচাতো ভাই গোলাম মস্তফা জানান, মাসখানেক ধরে তাঁদের এলাকায় চুরি বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা এলাকার সবাইকে নিয়ে বৈঠক করেন। উজির মিয়ার বাড়িতেও চুরির ঘটনা ঘটে। এসব বৈঠকে উজির মিয়া চুরি বন্ধে জোরালো ভূমিকা রাখেন। কিন্তু পুলিশ উল্টো তাঁকেই ধরে নির্যাতন করে চুরির মামলা দিয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, এলাকার চিহ্নিত কয়েক চোরকে ধরার পর তাঁরাই উজির মিয়ার নাম বলেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই পুলিশ তাঁকে আটক করে।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী মোক্তাদীর হোসেন বলেন, তাঁরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে উজির মিয়াকে গ্রেপ্তার করেন। থানায় নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়।

পরিবারকে টাকা দিতে চেয়েছিল পুলিশ

উজির মিয়ার পরিবারের সদস্যরা জানান, পুলিশের মারধরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া উজির মিয়াকে আদালত থেকে জামিনে মুক্ত করে যেদিন বাড়িতে নেন, সেদিন সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়িতে শান্তিগঞ্জ থানার দুজন পুলিশ কর্মকর্তা যান। এ সময় তাঁরা উজির মিয়ার শারীরিক অবস্থা দেখে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং চিকিৎসার জন্য পরিবারকে টাকা দিতে চান। কিন্তু উজির মিয়ার পরিবার সেই টাকা নেয়নি।

গোলাম মস্তফা বলেন, ‘আমরা আদালত থেকে উজির মিয়াকে পেয়ে দেখি, তিনি গুরুতর অসুস্থ। পরে বাড়িতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এলাকায় মানববন্ধনের ঘোষণা দিই। এরপরই সন্ধ্যায় শান্তিগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান ও উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আলা উদ্দিন আমাদের বাড়িতে আসেন। এ সময় তাঁরা আমাদের সান্ত্বনা দেন এবং এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন। এ সময় উজির মিয়া কথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর হাত-পা কাঁপছিল। পরে পুলিশের কর্মকর্তারা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং আমাদের কিছু টাকাও দিতে চান। কিন্তু আমরা সেই টাকা নিইনি।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। মো. আলা উদ্দিনও ফোন ধরেননি।

পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিবার

উজির মিয়ার মৃত্যু ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করবে তাঁর পরিবার। আজ ময়নাতদন্ত শেষে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে লাশটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় বিষয়টি তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানান। উজির মিয়ার চাচাতো ভাই গোলাম মস্তফা বলেন, ‘পুলিশের অমানবিক নির্যাতনের কারণেই উজির মারা গেছেন। আমরা আমাদের ভাইয়ের মৃত্যুর বিচার চাই। অবশ্যই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করব।’