সিলেটে গত কয়েক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা চলছে। ষাট থেকে সত্তরোর্ধ্ব অনেকে বলছেন, তাঁরা বন্যার এত পানি এর আগে দেখেননি। কী কারণে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো, এর ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ সংগঠকেরা বলছেন, সিলেটের প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। মূলত, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য মোটাদাগে এসব কারণই প্রধানত দায়ী।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ ও নদ-নদী নিয়ে কাজ করছেন, এমন দুজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে বন্যা থেকে রেহাই পেতে সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা, কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদ-নদী খনন করা জরুরি। এ ছাড়া সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো (প্রাকৃতিক) দখলমুক্ত করে খনন করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করা দরকার।
দীর্ঘদিন ধরেই সিলেটের পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন আবদুল হাই আল হাদি। তিনি সারি নদ বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সভাপতি। তিনি বলেন, ভূতাত্ত্বিকভাবে সিলেট একটি বৈচিত্র্যময় এলাকা। পাহাড়-টিলায় জনপদটি যেমন সমৃদ্ধ; তেমনি এখানে নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়ের কোনো কমতি নেই। তবে নদীগুলোর সব কটিরই উৎপত্তি হয়েছে ভারতে। সুরমা নদী ছাড়া বাকি নদীগুলোর অধিকাংশ এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল জায়গা ভারতের মেঘালয় থেকে। তাই মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর সবই চলে আসে সিলেটে।
আবদুল হাই আল হাদি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি বালু-মাটি-পলি জমতে জমতে নদ-নদীগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে, অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের কারণে নদীগুলো ক্রমে সংকোচন ও ভরাট হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নদীশাসনের নামে নদী-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড। যত্রতত্র স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও নদীর প্রবাহপথ আরও বেশি সংকুচিত হয়েছে। এতে এবার অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি জমে বন্যার সৃষ্টি করেছে। এ রকম পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য সিলেটের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নদী দখলমুক্ত করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাত হলে যেন পানির বাড়তি চাপ ধারণ করতে পারে, এ জন্য বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় ও জলাধার খনন করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, ‘মুষলধারে বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি ধারণ করতে পারছে না আমাদের নদ-নদী। বর্ষার পানি ধরে রাখত আমাদের হাওর, বিল বা জলাধারগুলো। অসংখ্য হাওর ও বিল ভরাট হয়েছে। এমনকি সরকারিভাবে হাওর ও বিল ভরাটের কাজ এখনো চলমান। এ অবস্থায় প্রথম দফা বন্যার পর দ্বিতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা নানাভাবে প্রকাশ করা হলেও সে বন্যা মোকাবিলায় সরকারি কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। অথচ মানুষকে সতর্ক করা উচিত ছিল। দায়িত্বশীল মহল থেকে মানুষকে সতর্ক করা হলে এখন সিলেটের মানুষকে এমন দুরবস্থার মুখোমুখি হতে হতো না।’
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলেন, ‘হুট করে বন্যা পরিস্থিতি উত্তরণের ব্যবস্থা নেই। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রথম কথা হলো যে আমাদের নদ-নদীগুলো খনন করা দরকার। খননটা আবার আন্দাজি করলে হবে না। নকশা করে, কোন দিক দিয়ে কীভাবে খনন করলে পাড় ভাঙবে না, খেতখামার নষ্ট হবে না, এগুলো দেখার বিষয়ও আছে। আবার দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে খননের সময় বালু নদীর পাড়েই রেখে দেয়, এভাবে লাভ হয় না। মোটকথা, খনন সঠিক পদ্ধতিতে করতে হবে।’
মুশতাক আহমদ আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমি যেটা মনে করি, সিলেটের বিশাল এলাকার পানি যায় শুধু একটা চ্যানেল দিয়ে, কালনী নদী দিয়ে। সুরমা ও কুশিয়ারা একসঙ্গে হয়ে কালনী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পানি এগোয়। বিশাল এলাকার পানি যাওয়ার জন্য এ জায়গা যথেষ্ট নয়। এ জায়গাকে ইম্প্রুভ করা দরকার। জায়গাটাকে দরকার হলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে আরও বাড়ানো ও গভীর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ ও সিলেটের পানি বের হয়ে যাওয়ার পথও তো অনেক কমে গেছে, পানি জমা থাকার জায়গাগুলোও কমে গেছে। হাওরের পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। অন্যদিকে, পাহাড়-টিলাও কিন্তু পানি শোষণ করে রাখে। অথচ নির্বিচারে সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটা চলছে, পুকুর ভরাট চলছে। এসব থামানো উচিত।’
সিলেটের নদ-নদীগুলো দীর্ঘদিন ধরে খনন না হওয়ায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন মুশতাক আহমদ। তিনি বলেন, মোটকথা হচ্ছে, নদী খনন করতে হবে এবং পুরো এলাকার পানি বের হওয়ার জন্য যে একটামাত্র পথ আছে—অর্থাৎ কালনী নদী—সেটাকে ইম্প্রুভ করলেই দ্রুত বন্যার পানি সরে যেতে পারবে। প্রয়োজনে কিছু সংযোগ খাল যদি তৈরি করা যায়, তাহলেও পানি দ্রুত বের হবে।