সাগরজলে বিস্তৃত হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ হচ্ছে সমুদ্রের জলরাশির ওপর। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দিনরাত সাগরজল ছুঁয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করবে এই রানওয়েতে। আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সমুদ্রে সম্প্রসারণ প্রকল্পে’র উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশে প্রথমবারের মত সমুদ্রবক্ষের ওপর নির্মিতব্য ১ হাজার ৭০০ ফুটের রানওয়ের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। রানওয়ের অন্তত ৭০০ ফুট থাকবে সমুদ্রের পানির ওপর। এটিই হবে দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে। বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক বিকাশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো (সিওয়াইডব্লিউসিবি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন-জেভি যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
কক্সবাজার শহরের উত্তর প্রান্তে নাজিরারটেক উপকূল। এই রানওয়ে তৈরি করতে গিয়ে নাজিরারটেক উপকূলের যেসব জলবায়ু উদ্বাস্তু শ্রমজীবী মানুষ ভিটেমাটি হারাচ্ছেন, তাঁদের জন্য তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট। ইতিমধ্যে ঝুপড়িঘর ছেড়ে ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে ৬০০ পরিবার। প্রায় ২০ লাখ টাকা দামের ফ্ল্যাটের বিপরীতে একটি পরিবারকে পরিশোধ করতে হয়েছে মাত্র ১ হাজার ১ টাকা।
শহরজুড়ে সাজ সাজ রব
কাল প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রান্তের অনুষ্ঠানে থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। গতকাল শুক্রবার দুপুরে প্রতিমন্ত্রী কক্সবাজার বিমান বন্দরে এসে পৌঁছান। তিনি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেন। আজ দুপুরে বিমানবন্দর এলাকায় সাংবাদিকদের প্রেস ব্রিফিং করে সমুদ্রজলের ওপর রানওয়ে তৈরির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী। এ সময় সঙ্গে ছিলেন একই মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আগামী ৫০ বছরের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিশেষ এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। রানওয়ে সম্প্রসারণকাজ শেষ হলেই এখানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ওঠা-নামা করতে পারবে ৩৮০-এর মতো সুপরিসর এয়ারবাস।
কক্সবাজার বিমানবন্দর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক স্বপ্ন উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, এই রানওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক বিকাশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। এই বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক এভিয়েশন হাব হিসেবে ব্যবহার হবে। আন্তর্জাতিক টার্মিনাল হবে, বিদেশি পর্যটকেরা সরাসরি কক্সবাজার আসার সুযোগ পাবেন। ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরও গতিশীলতা আসবে।
রানওয়ের নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে কক্সবাজার শহরজুড়ে চলছে ব্যাপক প্রচারণা। শহরের প্রধান সড়ক, সৈকত সড়কে বিলবোর্ড, পোস্টার, ফেস্টুন আর ব্যানারে ভরে গেছে। সন্ধ্যার পর শহরের মোড়ে মোড়ে বড় পর্দায় দেখানো হচ্ছে রানওয়ে নির্মাণ প্রকল্প (ভিডিও চিত্র)। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ দাঁড়িয়ে অন্য রকম রানওয়ের ভিডিও উপভোগ করছেন।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্বলতা অনেক। তাঁর বিশেষ আগ্রহে বর্তমানে কক্সবাজারে ৬৯টি মহাউন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ, মাতারবাড়ী কায়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যতম।
দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে হবে কক্সবাজার
বেবিচক সূত্র মতে, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। সাগরবক্ষে বিস্তৃত হওয়ার পর কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট। এটি হবে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজার থেকে সরাসরি পূর্ণ লোডে সুপরিসর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা, সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ ক্যাট-১ লাইটিং সিস্টেম সংস্থাপনের ফলে রাত্রিকালীন বিমান পরিচালনা, বিমানবন্দরে যাত্রী ও কার্গো পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আকাশপথে দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন সম্ভব হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনসচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন বলেন, বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ৯ হাজার ফুট রানওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন আরও ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ে সম্প্রসারণকাজের উদ্বোধন হচ্ছে কাল। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৪৭-৪০০ ও এয়ারবাসের মতো উড়োজাহাজ সহজেই ওঠা-নামা করতে পারবে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরে বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার-এর দৈনিক ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ১৮-২০টি ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। কক্সবাজার-যশোর রুটে চিংড়ি পোনা সরবরাহ দিচ্ছে কয়েকটি কার্গোবিমান।
সমুদ্রজলের রানওয়ের সম্প্রসারণ প্রকল্প শেষ হলে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বড় বড় উড়োজাহাজ এখানে অবতরণ করতে পারবে জানিয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান বলেন, আগামী ৫০ বছরের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিশেষ এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। রানওয়ে সম্প্রসারণকাজ শেষ হলেই এখানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ওঠা-নামা করতে পারবে ৩৮০-এর মতো সুপরিসর এয়ারবাস।
ঝুপড়িঘর থেকে ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক
কক্সবাজার বিমানবন্দরের পূর্ব পাশে বাঁকখালী নদী। তারপর (নদীর উত্তর-পূর্ব পাশে) দেশের সর্ববৃহৎ ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’। প্রকল্পের জন্য খুরুশকুলে অধিগ্রহণ করা হয় ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জমি।
প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার এ প্রকল্পে তৈরি হচ্ছে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন। যেখানে ঠাঁই হবে ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের অন্তত ২০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের। প্রতিটি ভবনে আছে ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি ফ্ল্যাট। ইতিমধ্যে ২০টি ভবনে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ৬০০ পরিবারের আড়াই হাজার মানুষের। উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই জেলে, শুঁটকিশ্রমিক, রিকশা, ভ্যানচালক ও ভিক্ষুক। একসময় তাঁরা বসতি করতেন সমুদ্র উপকূলের নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল এলাকার ঝুপড়িঘরে। এখন সেখানে তৈরি হচ্ছে বিমানবন্দরের রানওয়ে। রানওয়ের কারণে উচ্ছেদ হওয়া জালবায়ু উদ্বাস্তুরা এখন ফ্ল্যাটের মালিক।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২৩ জুলাই প্রথম ধাপে ২০টি ভবনে ৬০০টি ফ্ল্যাটবাড়ির চাবি হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে বিমানবন্দরের পাশে সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নিয়েছিলেন এসব গৃহহীন মানুষ।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় আনা পরিবারগুলোর আর্থ–সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল, ক্লিনিক, পানি সরবরাহব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, বিনোদনের পার্ক ইত্যাদি। ঝুপড়িঘরের শ্রমজীবী মানুষের ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকার এমন প্রকল্প বিশ্বের কোথাও আছে বলে মনে হয় না।