সরকারের উদ্যোগ রয়েছে, তবে শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি
২০১৭-১৮ অর্থবছরে রংপুর নগরের সাবান, অ্যালুমিনিয়াম ও পাথর ক্রাশিং—এই তিন খাতকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
রংপুর নগরের অনেক এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হচ্ছে না। মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপ, গাড়ির গ্যারেজ, স্টিল ও কাঠের আসবাবের দোকান, ভাঙারির দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ওয়েল্ডিংয়ের দোকান ও বহুতল ইমারত নির্মাণকাজে এখনো শিশুরা শ্রম দিয়ে চলেছে। রংপুরে শিশুশ্রমিকের সঠিক হিসাব জানাতে না পারলেও কর্তৃপক্ষের দাবি, বেশ কিছু উদ্যোগের ফলে আগের থেকে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেছে।
আজ ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি সামনে রেখে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) জেলা শাখার সভাপতি সদরুল আলম বলেন, বাংলাদেশে শিশুশ্রম বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র্য। এদের বেশির ভাগ
পরিবার অসচ্ছল। ফলে এসব পরিবারের শিশুরা তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য ছোট থেকেই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ঝরে পড়ে।
সদরুল আলম আরও বলেন, মোটর ওয়ার্কশপ, ওয়েল্ডিং, লেদ মেশিন, নির্মাণশ্রমিক, ইটভাঙা, হোটেলশ্রমিক, স্টিলের আলমারির দোকানের মতো বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের দেখা মিলছে।
সরেজমিনে নগরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, সাতমাথা, মডার্ন মোড়, সিও বাজার, কলেজ রোড, স্টেশন রোড এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন মোটর গ্যারেজে শিশুরা কেউ ট্রাকের চাকার টায়ার পাল্টাতে, আবার কেউ স্টিলের বিভিন্ন আসবাব তৈরিতে ব্যস্ত। আবার ওয়েল্ডিংয়ের দোকানে লোহা পেটানোর কাজ করছে শিশুরা। এদের বয়স ১২-১৩ বছর হবে। নিয়ম রয়েছে ১৪ বছরের নিচে কেউ হালকা শ্রম ও ১৮ বছরের নিচে ভারী শ্রম, ছোট-বড় কারখানায় শ্রম দিতে পারবে না।
কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে ওয়েল্ডিংযন্ত্রে কাজ করার সময় একজন ১৩ বছরের শিশুর সঙ্গে কথা হয়। নাম না জানিয়ে সে বলে, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে সে। তিন ভাইবোন। বাবা রিকশা চালান। মা মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। বাবার টাকায় সংসার চলে না। তাই কাজে ঢুকেছে।
নগরের সাতমাথা এলাকায় একটি লেদ মেশিন কারখানায় কথা হয় ১৩ বছরের এক শিশুশ্রমিকের সঙ্গে। নাম জানতে চাইলে সে বলে, ‘স্যার পত্রিকাত নাম লিখলে অসুবিধা হইবে। এর আগোত একবার মোর ছবি পেপারোত তুলি দিছলো। তাতে করে পরে কাম পাওয়া যায় না। তাই নাম দেন না।’ সে জানাল, তার বাবা একটি হোটেলের কর্মচারী। সামান্য টাকায় মা–বাবাসহ তিন ভাইবোনের খরচ চলে না বলেই দুই বছর থেকে এই কাজ করে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, শিশুরা কম বয়সে যেন কাজ না করে, এ জন্য সরকারি উদ্যোগে কিছু বেসরকারি সংস্থা হতদরিদ্র অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অভিভাবকদের সচেতন করতে কাজ করছে। এসব পরিবারকে বোঝানো হচ্ছে যে তারা যেন তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে না পাঠায়। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। শিশুশ্রম বন্ধে প্রতি তিন মাস পরপর জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লোকজন নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রংপুর নগরের সাবান, অ্যালুমিনিয়াম ও পাথর ক্রাশিং—এই তিন খাতকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, নির্মাণশিল্প, সিরামিকশিল্প খাতে শিশুশ্রম নিরসনের চেষ্টা চলছে।
এদিকে শিশুরা যেন কাজে না যায়, এ জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিশুদের সরকারিভাবে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের দক্ষতা উন্নয়নে ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। রংপুর নগরে উপ-আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০০। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ২৫ জন করে শিশু রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে আটটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতিটি শিশুর পরিবারকে মাসে এক হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে।
শিশুশ্রমিকের পরিসংখ্যান চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর রংপুর কার্যালয়ের পরিদর্শক লঙ্কেশ্বর রায় তা দিতে পারেননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রংপুর নগরে ছোট-বড় ৪০টি কারখানা রয়েছে। এগুলোতে শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করছেন তাঁরা। এসব প্রতিষ্ঠানের গত ছয় মাসে ১২ জন শিশুকে নিরসন করেছেন তাঁরা।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, শিশুশ্রম নিরুৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে যে কর্মসূচি শুরু হয়েছে, তাতে করে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেন শিশুদের কাজে নেওয়া না হয়, এ জন্য প্রতিটি পরিবারকেও সচেতন হতে হবে।