জাতীয় চা দিবস আজ
সমতলে চা চাষের পরিধি বাড়ছে
পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় চা চাষের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। এবারের মৌসুমে ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদনের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বামী মারা যাওয়ার পর চার সন্তানকে নিয়ে অভাব নেমে আসে সুফিয়ার সংসারে। স্বামী এক একর জমি রেখে গেলেও তা উঁচু হওয়ায় প্রায়ই পতিত পড়ে থাকত। ২০১৪ সালে আশপাশের লোকজনকে দেখে দেড় বিঘা জমিতে চা চাষ শুরু করেন সুফিয়া খাতুন। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। চা চাষ করে যে আয়, তা দিয়ে এখন স্বাবলম্বী সুফিয়ার পরিবার।
সুফিয়া খাতুন (৫০) পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের কাজিরহাট-উত্তর তালমা এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, তাঁর চার বিঘা জমির চা–বাগান থেকে প্রতিবছর ছয়টি পর্বে চা–পাতা সংগ্রহ করা যায়। প্রতি পর্বে এক লাখ টাকা করে চা–পাতা বিক্রি হয়। সেই হিসাবে বছরে ছয় লাখ টাকা আসে। তবে খরচপত্র বাদ দিয়ে প্রতিবছর তাঁর দুই লাখ টাকা লাভ থাকে। তবে যদি সব সময় চা–পাতার ন্যায্যমূল্য পান, তাহলে দিন দিন চা চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।
শুধু সুফিয়া খাতুনই নন, জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির আনাচকানাচে ক্ষুদ্র পর্যায় থেকে শুরু করে স্টেট পর্যায় পর্যন্ত চাষ হচ্ছে চায়ের। পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় চা চাষের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। এবারের মৌসুমে (২০২২) উত্তরাঞ্চলে ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদনের আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, পার্বত্য ও সিলেট অঞ্চলের পর তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে উত্তরাঞ্চল। পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলাতেও চা চাষ বাড়ছে। গত চায়ের মৌসুমে (২০২১) জাতীয় উৎপাদনের ১৫ শতাংশ চা যুক্ত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমি থেকে। ২০২১ সালে সারা দেশে চায়ের উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি। এর উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলা থেকে সরবরাহ করা হয় ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে সমতল ভূমিতে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলামের চেষ্টায় স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে চা-চাষ শুরু হয়। ২০০০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বাগান পর্যায়ে চা-চাষ শুরু করে। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২১টি বড় চা–বাগান (২৫ একরের বেশি) রয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৭৪৫টি নিবন্ধিত ও ৮ হাজার ৬৭টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা–বাগানে (০ থেকে ২৫ একর) রয়েছে। মোট ১১ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৯৪ একর জমিতে চা-চাষ সম্প্রসারণ হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, উত্তরাঞ্চলে এ পর্যন্ত ৪১টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় ২২টি কারখানা চালু রয়েছে। এ কারখানাগুলো চা-চাষিদের কাছ থেকে সবুজ চা পাতা কিনে তা থেকে চা তৈরি (মেড টি) করে। পঞ্চগড়ে উৎপাদিত এ চা নিলাম বাজারে (চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গল) বিক্রি করেন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা। প্রতিবছর মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত হলো চায়ের উৎপাদন মৌসুম। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চা পাতা সংগ্রহ ও কারখানাগুলোতে চা উৎপাদন বন্ধ থাকে।
তবে তিনজন চা-চাষি বলেন, ভরা মৌসুমে এসে চা পাতার উৎপাদন বেশি হয়ে যাওয়ায় প্রায় প্রতিবছরই কাঁচা চা পাতার দাম কিছুটা কমে যায়। এতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁদের দাবি, প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বৃদ্ধির পাশাপাশি চায়ের তৃতীয় নিলাম বাজার পঞ্চগড়ে স্থাপন করতে হবে।
জেলা চা চাষি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সায়েদ আলী বলেন, ‘আমাদের দাবি, পঞ্চগড়ে চা–কারখানাগুলো সরকার নির্ধারিত দামে চাষিদের কাছ থেকে চা–পাতা ক্রয় করুক। বর্তমানে জেলা প্রশাসন প্রতি কেজি কাঁচা চা–পাতা ১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে, সেটাও অনেক সময় কারখানামালিকেরা দিতে চায় না।’
পঞ্চগড়ের নর্থ বেঙ্গল টি ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পঞ্চগড় চা চাষের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা। তবে চাষিদের কাঁচা চা–পাতা চয়ন যদি মানসম্মত হয়, তাহলে তৈরি চা–ও মানসম্মত হবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, সমতল ভূমিতে চা চাষের জন্য পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা। এর আগে ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প’ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় চাষিদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলে’ হাতে–কলমে কর্মশালা হচ্ছে। এ আঞ্চলিক কার্যালয়ে একটি পেস্ট ম্যানেজমেন্ট ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে চা–চাষিদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেওয়া হয়।