সখীপুরে খাজনা আদায় বন্ধ ২১ বছর ধরে
‘খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল/ বর্গি এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/ খাজনা দিব কিসে/ ধান ফুরাল, পান ফুরাল/ খাজনার উপায় কী/ আর ক’টা দিন সবুর কর/ রসুন বুনেছি।’
বর্গিদের অত্যাচার ও জমির খাজনা দিতে অসমর্থ দরিদ্র কৃষকদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে কোনো একসময় রচিত হয় এই লোকছড়া। কিন্তু টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার ১৪টি মৌজায় ঘটেছে ওই ছড়ার ঠিক উল্টোটা। এখানে প্রজা (ভূমিমালিক) খাজনা দিতে চায় কিন্তু স্থানীয় ভূমি কার্যালয় (রাজা) খাজনা নিচ্ছে না। মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতায় উপজেলার কমপক্ষে এক লাখ মানুষ শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় ভোগদখলীয় প্রায় ৩৫ হাজার একর জমির খাজনা দিতে পারছে না ২১ বছর ধরে। জমির নামজারি না হওয়ায় বৈধ প্রক্রিয়ায় (রেজিস্ট্রি করে) ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছে না। ফলে রাজধানী ঢাকার কাছে হলেও সখীপুরে গড়ে উঠছে না কোনো কলকারখানা। আর বিপাকে পড়েছে আগে ভবন নির্মাণ করে কার্যালয় গড়া বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও)। প্রশিকা, গ্রামীণ প্রযুক্তি, ব্যুরো-বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি এনজিওকে প্রতিবছরই বহুতল ভবন সরিয়ে নিতে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় নোটিশ দিয়ে যাচ্ছে।
খাজনা দেওয়ার দাবিতে উপজেলায় ভূমিমালিকদের নিয়ে প্রায় দেড় যুগ আগে একটি আন্দোলন কমিটিও গঠিত হয়েছে। ওই কমিটি নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। নিজ এলাকায় হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালনের পর ২০১৭ সালের ২২ মে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। এ ধরনের বড় কর্মসূচির খবর পেয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাস দিলে আন্দোলন থেমে যায়। এর মধ্যেই ওই জেলা প্রশাসক বদলি হয়ে যান। এরপর ওই বছরের ৩১ জুলাই নতুন জেলা প্রশাসক খান নুরুল আমিনের সঙ্গে আন্দোলনকারীরা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) আহ্বায়ক ও সখীপুর সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্যসচিব করে ৯ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। এরপর ওই কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করলেও ভূমির জটিলতা নিরসনে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। তবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি সূত্র দাবি করে, ভূমিমালিকদের দাবির পক্ষের প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে ২০১২ সালের ১৯ মার্চ আন্দোলনকারীরা সখীপুর থেকে ঢাকা শহরে গিয়ে মহানগর নাট্যমঞ্চে আমরণ অনশন করেন। ওই কর্মসূচিতে তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম অনশনকারীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অনশন ভাঙান।
সখীপুর ভূমি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি ও সখীপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিগগির আটিয়া বন অধ্যাদেশ-৮২ বাতিল হচ্ছে। ওই অধ্যাদেশ বাতিল হলে কিছুটা হলেও ভূমিমালিকদের উপকার হবে। এ সমস্যা নিয়ে আগেও অনেক আন্দোলন হয়েছে। এবার আরও কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা চলছে। যে পর্যন্ত খাজনা নেওয়া না হবে, সে পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন থামবে না।’
গড়গোবিন্দপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম বলেন, ‘১০০ থেকে ১৫০ বছর ধরে ভোগদখল করলেও খাজনা না নেওয়ায় আমরা জমি চাষাবাদ করতে পারলেও বৈধভাবে বিক্রি করতে ও ব্যাংকঋণ তুলতে পারছি না। আমরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে আছি।’
আন্দোলন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জুলফিকার হায়দার কামাল বলেন, ‘খাজনা নেওয়ার বিষয়ে আবারও আন্দোলনে নামার চিন্তাভাবনা করছি।’
উপজেলার এ ১৪টি মৌজা হচ্ছে গড়গোবিন্দপুর, সখীপুর, প্রতিমাবংকী, লাংগুলিয়া, বেড়বাড়ি, রতনপুর, হাতীবান্ধা, হতেয়া, বাজাইল, কালমেঘা দেওয়ানপুর, কালমেঘা আতিয়া, কালমেঘা তালেপাবাদ, চতলবাইদ ও বহুরিয়া চতলবাইদ।
সখীপুরে সংশ্লিষ্ট ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ ১৪টি মৌজায় ১৯৭৬-৮৫ সালে দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে আরএস (রিভিশন সার্ভে) জরিপ সম্পন্ন হয়। এরপর ভূমিমালিকদের বরাবর নকশা ও পরচা দেওয়া হয়। ১৪ মৌজার মধ্যে প্রথমে ৮টি মৌজার ভলিউম স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে আসে এবং খাজনা আদায়ের নির্দেশও আসে। ওই সময় (১৯৯৮ সাল) বন বিভাগ তাদের কিছু জমি ওই রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দাবি করে আপত্তি দিলে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় খাজনা (ভূমিকর) নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পার হলেও আর খাজনা নেওয়া হয়নি। ১৪ মৌজার খাজনা আদায় না হওয়ায় সরকার প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সখীপুর প্রশিকা: মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. রতন মিয়া বলেন, ‘প্রশিকা আজ থেকে ৩০ বছর আগে প্রথমে ১০ শতাংশ ও পরের বছর ৬০ শতাংশ জমি কিনে পাকা ভবন করে কার্যালয় বানিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত ওই জমির খাজনা নিলেও পরে আর নিচ্ছে না। মাসখানেক আগে আমাদের কোনো নোটিশ না দিয়ে সীমানাপ্রাচীরের ভেতর পৌরভূমি কার্যালয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান লিখে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে সখীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আয়শা জান্নাত তাহেরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হওয়ায় আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা না আসায় আমরা ভূমি উন্নয়ন কর নিতে পারছি না।’
সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুর রহমান সম্প্রতিতাঁর কার্যালয়ে বসে প্রথম আলোকে বলেন, সখীপুরে একই জমিতে বন বিভাগ, ভূমি অফিস ও স্থানীয়রা মালিকানা দাবি করায় এবং সীমানা নির্ধারণ (ডিমারকেশন) না থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন দরকার বন বিভাগ ও ভূমি কার্যালয়ের যৌথ জরিপ। জরিপ ছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ জোয়াহেরুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাজনা সমস্যা নিয়ে আমি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে সুস্পষ্টভাবে আমার বক্তব্য তুলে ধরেছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। শিগগির সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।’