ফরিদপুরের সালথা
লাঠিপেটায় শুরু, গুজব ছড়িয়ে তাণ্ডবে শেষ
উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর বাসভবন এবং এসি ল্যান্ডের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে হামলা। গাড়িতে আগুন। নিহত ১।
কেউ কেউ গুজব ছড়ায়, পুলিশের গুলিতে অনেকে মারা গেছে। আবার কোনো দিক থেকে গুজব ছড়ানো হয়, মাদ্রাসার মুহতামিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন নানা গুজবে জড়ো হয় বহু মানুষ। একপর্যায়ে তারা হামলা চালায় ফরিদপুরের সালথা থানা, উপজেলা কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন সরকারি কার্যালয় ও আবাসিক ভবনে। আগুন দেওয়া হয় কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনারের (এসি ল্যান্ড, ভূমি) গাড়িতে। পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন এসব কথা।
গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঘটেছে এসব ঘটনা। এতে নিহত হয়েছেন একজন। আহত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অন্তত ৩০ জন।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সালথার সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা বাজারে করোনা মোকাবিলায় সরকারি বিধিনিষেধের কার্যকারিতা পরিদর্শনে যান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান। এ সময় তাঁর গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে কয়েকজনকে লাঠিপেটা করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
ফুকরা বাজারের ব্যবসায়ী পিকুল শেখ বলেন, এসি ল্যান্ডের গাড়িটি সন্ধ্যায় বাজারে আসে। পরে ওই গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে বাজারের তিন-চারজনকে লাঠিপেটা করেন। এ ঘটনায় বাজারের লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে এসি ল্যান্ড দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, লাঠিপেটায় নটাখোলা গ্রামের মো. জাকির হোসেন মোল্লা (৪৫), নিজামউদ্দিন (৩৬) ও মঞ্জুর শেখসহ (৩৩) কয়েকজন আহত হন।
তবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর গাড়ি থেকে কেউ নেমে কাউকে লাঠিপেটা করেনি। ওই বাজারে তিনি কিছু লোককে সংঘবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পান।
তাদের গতিবিধি ভালো মনে না হওয়ায় তিনি দ্রুত তাঁর লোকজন নিয়ে চলে যান এবং বিষয়টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুজ্জামানকে জানান।
মারুফা সুলতানা আরও বলেন, খবর পেয়ে সালথা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ বাজারে গেলে উত্তেজিত জনতা তাঁদের ওপর হামলা করে। এতে মিজানুর রহমানের মাথা ফেটে যায়। এরপর পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে সালথা থানা ঘেরাও এবং উপজেলার বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, স্থাপনা ও বাসভবনে ভাঙচুর ও আগুন দেয় হামলাকারীরা।
সালথা থানার ওসি আশিকুজ্জামানও বলেন, এসি ল্যান্ডের কথা শুনে পুলিশের একটি দল ফুকরা বাজারে গেলে তাঁদের ওপর হামলা হয়।
ভাঙচুর, আগুন
স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে কয়েক হাজার লোক উপজেলা কমপ্লেক্স ও থানার সামনে জড়ো হয়। এ সময় তারা কমপ্লেক্স ও থানার ফটকে আগুন দেয়। রাত সাড়ে নয়টার দিকে উপজেলা কমপ্লেক্সের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায়। একপর্যায়ে তারা ইউএনওর বাসভবন, উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের বাসভবন, উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে হামলা চালায়। উপজেলা কমপ্লেক্সের নিচতলায় উপজেলা ত্রাণ কর্মকর্তার কার্যালয়, নির্বাচন কার্যালয়, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার অফিসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ সময় ত্রাণসামগ্রীও লুট করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ইউএনও ও এসি ল্যান্ডের দুটি গাড়ি ও বিভিন্ন আসবাব। এ ছাড়া তিনটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও পাঁচটি ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালও।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয় উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনে হলেও তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। হামলাকারীদের প্রতিরোধের মুখে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বেরই হতে পারেননি।
সালথা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা আগুন নেভানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু এর আগে দেড় থেকে দুই হাজার লোক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘেরাও করে। হামলাকারীরা আমাদের হুমকি দেয়, আগুন নেভালে মেরে ফেলা হবে।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলেছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ উপজেলা চত্বরে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা-ভাঙচুর চালায়। এর মধ্যেই থানা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন জুবায়ের হোসেন (২০)। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। পরে সালথা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যরা। তাঁরা ৫৮৮টি শটগানের গুলি, ৩২টি কাঁদানে গ্যাসের শেল, ২২টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৭৫টি রাইফেলের গুলি ছুড়ে রাত ১২টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
নিহত জুবায়ের হোসেনের বাড়ি উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তপুর গ্রামে। তিনি একটি মাদ্রাসার ছাত্র বলে জানা গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সালথা উপজেলা কমপ্লেক্স, থানা এবং আশপাশের এলাকা ঘুরে তাণ্ডবের চিত্র দেখা যায়। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর বাসভবনের অধিকাংশ কাচই ভাঙা। উপজেলা কমপ্লেক্স চত্বর আর থানা চত্বরে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ইটের টুকরো। উপজেলা কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সামনে আধা পোড়া কাঠ পড়ে আছে। পড়ে আছে অনেক ইটের টুকরো। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সামনেও একই পরিস্থিতি। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের সব কাচ ভেঙে গেছে।
‘হামলা পরিকল্পিত’
সালথা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ মাতুব্বর প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ দিন ধরে হেফাজতে ইসলামের সমর্থকেরা সালথায় উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ফেসবুকে বিভিন্ন মিথ্যাচার প্রচার করে পরিকল্পিতভাবে এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বাহিরদিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ (মুহতামিম) আকরাম আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশের গুলিতে সাত-আটজন নিহত হয়েছে—এ জাতীয় নানা গুজব ছড়িয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে।
সালথার ইউএনও মো. হাসিব সরকার বলেন, এটি পরিকল্পিত সন্ত্রাস। মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে সরকারি জমি উদ্ধার করার প্রক্রিয়ায় যাদের ক্ষোভ ছিল, তারা পরিকল্পিতভাবে এ তাণ্ডব চালিয়েছে।
ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার এবং পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানও সোমবারের ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেছেন। জেলা প্রশাসক বলেন, অশুভ শক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, এই হামলার ঘটনায় ফুকরা বাজারের ঘটনার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি ও মামলা
থানায় হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে গতকাল রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলার প্রস্তুতি চলছিল। এ ছাড়া যেসব সরকারি কার্যালয়ে হামলা হয়েছে, সেগুলোর পক্ষ থেকেও মামলার প্রস্তুতি চলছে। তবে সহিংসতার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করার কথা জানায়নি পুলিশ।
জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর একটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাসলিমা আলীকে। অপর কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসলাম মোল্লাকে। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ দুই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।