রোহিঙ্গাদের সম্মতি না থাকায় প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তা
মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমোরা শালবাগান শিবিরে প্রথম দিন ২১টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তবে সাক্ষাৎকার দানকালে কোনো রোহিঙ্গাই বিনা শর্তে মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হননি। তাঁদের সবার দাবি মিয়ানমারের নাগরিকত্ব।
কাল ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সম্মতি না থাকায় ওই দিন প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আজ বুধবারও চলবে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার।
সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের কেরুনতলী ঘাট ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে পৃথক দুটি প্রত্যাবাসনকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের জন্য ৩ হাজার ৫৪০ জনের নামের তালিকা পাঠায়। তালিকার অধিকাংশই টেকনাফের জাদিমোরা শালবাগান শিবিরের বাসিন্দা।
এই শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ ও আরআরআরসির সহকারী মো. খালেদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ৩ হাজার ৫৪০ জনের মধ্যে এই শিবিরে থাকা ৩ হাজার ৯১ জনের নামের তালিকা হাতে এসেছে।
আঁরা বর্মাত ন যাইয়ুম
সকাল সাড়ে নয়টায় শালবাগান শিবিরে গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা বার্মিজ ভাষায় লেখা প্রচারপত্র নিয়ে আলোচনা করছেন। প্রচারপত্রে বলা আছে, প্রত্যাবাসনের পর রাখাইন রাজ্যে তাঁদের করণীয় কী?
আরিফ উল্লাহ (৫৫) নামের এক রোহিঙ্গা বললেন, এসব মিয়ানমার সরকারের ভাঁওতাবাজি। জীবনেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে না মিয়ানমার। রাখাইন রাজ্যে গিয়ে কোনো রোহিঙ্গা নতুন শরণার্থী জীবন চায় না।
সকাল ১০টার দিকে শিবিরের আরআরআরসির সহকারী মো. খালেদ হোসেনের কার্যালয় থেকে একে একে ১০টি দল বের হয়ে শিবিরের বিভিন্ন ব্লকে ঢুকে পড়ে। প্রতিটি দলের সদস্য সংখ্যা ১০। দলে আছেন ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি, আরআরআরসির প্রতিনিধি, রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী, রোহিঙ্গা মাঝিসহ অনেকে। তাঁরা ঘরে ঘরে গিয়ে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করেন।
দুপুর ১২টার দিকে একদল রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের কাজে বাধার সৃষ্টি করে। তাদের দাবি, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো যাবে না। এ নিয়ে হইচই শুরু হলে ক্যাম্প ইনচার্জ খালেদ হোসেন ও টেকনাফ থানার অপারেশন অফিসার (পরিদর্শক) রাকিবুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশের উপস্থিতি দেখে বাধাদানকারী রোহিঙ্গারা পালিয়ে যায়।
এরপর বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার। ক্যাম্প ইনচার্জ বলেন, প্রথম দিন ২১টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এই পরিবারগুলোর লোকসংখ্যা শতাধিক।
সাক্ষাৎকার শেষে হাসিনা বেগম (৩৫) প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষাৎকারের জন্য গেলে তাঁকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি কি না জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে তিনি না বলেছেন। কারণ জানতে চাইলে বলেন, রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ নেই।
জুহুরা বেগম (৪৫) ও জমিলা আকতার (৪০) নামের অপর দুই রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমরাও যাব না বলে দিয়েছি। কারণ, প্রথমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। সেখানে (রাখাইনে) শান্তিতে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। রাখাইনে ফিরে গিয়ে আমরা দ্বিতীয়বার মরতে চাই না।’
একই কথা বলেন সাক্ষাৎ দিয়ে আসা রোহিঙ্গা আবু ছিদ্দিক (৩২) ও শামসুল আলম (৪২)।
এই শিবিরের নারী চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, সাক্ষাৎকার দেওয়া কেউই বিনা শর্তে মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। তিনি বলেন, তারা ৬৫টি পরিবারকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য বোঝান, কিন্তু ২১টি পরিবার রাজি হয়।
শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবদুল শুক্কুর ও মো. বশর বলেন, কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে।
এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ওই দিন শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাবাসন ভন্ডুল হয়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ২২ আগস্ট দিনক্ষণ ঠিক আছে। প্রত্যাবাসনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। তবে জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে না।